শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

‘আশরাফিয়া নোবেলপ্রাপ্তি কোচিং সেন্টার’ : ইউনূসবধ কাব্য : বাই হার এক্সপার্ট মিনিস্টারস



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নজিরবিহীন কতগুলো ঘটনা ঘটিয়ে বসে আছে শাসকরা, দেশের বিরোধী দলগুলোর ৩৩ জন নেতাকে একসঙ্গে জেলে পাঠিয়ে স্থাপন করেছে এক আক্কেলগুড়ুম হওয়া দৃষ্টান্ত। জননেতা ইলিয়াস আলীর কোনো খবর দিচ্ছে না সরকার। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখন হিমাগারে। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যার কারণ অনুদ্ঘাটিত। পুলিশের নির্মম নির্যাতনে মারা গেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক আজিজুর রহমান। পুলিশি বর্বরতার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু ও খায়রুল কবির খোকন। মাধবপুরে পাওয়া গেছে ছাত্রদল কর্মীর মাথাকাটা লাশ। তানোরে পাওয়া গেছে যুবক উজ্জ্বলের মৃতদেহ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে মরছে ৩০ জন করে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ। প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে মা-বোনেরা। উল্টোদিকে, জনতার দিকে বীরদর্পে গুলি ছুঁড়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি গিয়াস উদ্দিন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস কেলেঙ্কারির ঐতিহ্যবাহী পথ ধরে আরেক এমপি শামসুল হক চৌধুরীর এপিএসের গুদাম থেকে র্যাব উদ্ধার করেছে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা।
তবুও আমার আজকের বিষয় ইউনূসবধ কাব্যের দ্বিতীয় পর্ব।
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন, দুর্নীতির বদনাম ঘোচাতে পারলে তিনি বিশ্বব্যাংককে বলবেন পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দিতে। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রণব মুখার্জি পুরনো প্রেমের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন তার অফিসে গিয়ে। তারপর ঠাস ঠাস করে বললেন, দলনিরপেক্ষ ফ্রি এবং ফেয়ার ইলেকশন তারা বাংলাদেশে দেখতে চান। বললেন কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়, ভারতের বন্ধুত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে।
এইসব শুনে শুনে এমনিতেই মাথায় বায়ু চড়ছিল আমাদের সরকারের। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের আগমন ও প্রস্থানের পর সরকারের ভেতরকার বায়ু ঊনপঞ্চাশ রকমের টাইফুন সৃষ্টি করেছে। যার লণ্ডভণ্ড তাণ্ডবে এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দেশবাসীর।
সাধু ভাষায় হিলারি বয়ান
বাংলা সাহিত্যে ‘মঙ্গল কাব্য’ নামে একটি ধারা রহিয়াছে। দেবীদের তুষ্ট করিবার জন্য, আরাধনার অংশ হিসাবে বাংলাভাষী কবিরা ‘মঙ্গল কাব্য’ লিখিয়া দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করিতেন। আপনার জন্যও ‘অন্নদা মঙ্গল’, ‘চণ্ডী মঙ্গল’, ‘মনসা মঙ্গল’ জাতীয় ‘হিলারি মঙ্গল’ লিখিয়া পুণ্যলাভের খায়েশ আমার ছিল। কারণ মানবকুলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই ব্যক্তির একজন আপনি। আবার আপনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর মাতাও বটে। আপনাকে সকাল-বিকাল কদমবুচি না করিলে ক্ষমতায় থাকাও যায় না, ক্ষমতায় আরোহণও করা যায় না।
কিন্তু এ আপনি কী করিলেন? জগতের আগুন নির্বাপণের বদলে আপনি আমাদের শাসকদের দিলের আগুন ৭০ গুণ বাড়াইয়া দিয়া গেলেন। সেই আগুনে আমাদের শাসকদের চক্ষু অগ্নিবর্ণ ধারণ করিয়া সকল কিছু সংহার করিতে এখন উদ্যত। মাঝখানে পড়িয়া নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবন দ্বিতীয়বারের মতো শিক কাবাব হইবার উপক্রম হইয়াছে।
মাতঃ হিলারি, হে মহামহিম মার্কিনি দেবী, আপনি বিমানবন্দরে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে ৫০ মিনিট ঠা ঠা রৌদ্রের মধ্যে খাড়া করাইয়া রাখিলেন। দীপু মনি রৌদ্রে পুড়িয়া ঘামে ভিজিয়া যখন জেরবার, সেই সময় আপনি বিমানের বাহিরে আসিলেন। এই কর্মের পর, যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আপনি ইলিয়াস আলী, আমিনুল ইসলাম এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নাম উচ্চারণ করিলেন। ইহার পর আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে ডিনার খাওয়ার দীপু মনির নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় গমন করিলেন। এইখানেই শেষ নহে, ইহার পর তাহার সাথে হাসিয়া হাসিয়া একত্রে ডাবের পানি, জামরুল, পাটিসাপটা পিঠা ইত্যাদি ভক্ষণ করিয়া, ইলিয়াস-কন্যাকে কোলে তুলিয়া ছবি তুলিলেন। পরদিন সকালে শাসকদের না জানাইয়া তরুণ-তরুণীদের সাথে বাংলাদেশী আড্ডা দিলেন। এইখানেই যদি সব সমাপ্ত হইতো তাহা হইলে হয়তো কিছু হইতো না। কিন্তু গরম তপ্ত চুল্লির উপর ঘৃত ঢালিয়া দিয়া আপনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদের সাথে একান্তভাবে ঘরোয়া সাক্ষাত্কারে মিলিত হইলেন। তাহারপর তিনজনে একত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সাফাই গাহিলেন। তাহারপর শাসকদের অষ্টরম্ভা দেখাইয়া আপনি বাংলাদেশ ত্যাগ করিলেন।
মাতঃ, আপনি তো উড়াল দিয়া পগাড় পার হইলেন। পিছনে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল আমাদের আমির উমরাহ এবং উজির সাহেব ও সাহেবানদের সৃজনশীলতা।
তাহাদিগের মধ্যে দৃশ্যমান এইরকম সৃজনশীলতাকে বক্ষে ধারণ করিয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রণয়ন করিয়াছিলেন ‘ইউনূসবধ কাব্য’-এর প্রথম পর্ব। তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া তাহার পারিষদবর্গ এবার কোমরে গামছা বাঁধিয়া ‘ইউনূসবধ কাব্য দ্বিতীয় পর্ব’ রচনার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন।
মাতঃ হিলারি, এ আপনি কী করিলেন?
নস্ট্রাডুমাস হইতে সাজেদা চৌধুরী
দিনটি ছিল ৮ মে ২০১২। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর ৭৭তম জন্মদিন। ওইদিন আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতে তার মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে রুহানি ফয়েজ হাসিল হলো। তিনি পৃথিবীখ্যাত ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডুমাস ও শাহ নেয়ামতুল্লাহর মতো দিব্যজ্ঞান লাভ করে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন।
ওইদিন গুলশানের নিজ বাসভবনে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজ অলৌকিক ক্ষমতা লাভের প্রথম কিস্তি জাহির করে বললেন, খালেদা জিয়া কোনোদিন রাজনীতি করেননি। তার স্বামী কিছু সময় ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। না, এটা তার ভবিষ্যদ্বাণী নয়, এটা হলো ‘অতীত কালচার’। তবে এই অতীত কালচার বয়ান করার সময় তিনি অবশ্য সঙ্গত কারণেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে মরহুম শেখ মুজিব কর্তৃক গণতন্ত্রবধের অনন্য কীর্তি চেপে গেছেন। যেমন চেপে গেছেন ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার কালো দিনটির কথা।
থাক সে কথা। তার ভবিষ্যদ্ববাণী নিয়ে কথা বলি। তিনি ওই অনুষ্ঠানেই ভবিষ্যদ্বাণী করে জাতিকে শিহরিত করে বলেছেন, ‘ড. ইউনূস ক্ষণস্থায়ী। এরা কিছুদিনের জন্য আসে আবার চলে যায়। একদিন হারিয়ে যাবে।’ কে কে ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবেন না, সে কথা তিনি না বললেও তার গুণমুগ্ধরা বলছেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, মাহবুব উল আলম হানিফ, দিলীপ বড়ুয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, আসলাম সানী, শামীম ওসমান, জয়নাল হাজারী, সৈয়দ আবুল হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ফারুক খান প্রমুখ ব্যক্তি হয়তো ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। তারা হারিয়ে যাবেন না।
আমরা জানি না, শ্রদ্ধেয়া সাজেদা চৌধুরী এরপর কোনো ‘ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান কেন্দ্র’ খুলবেন কিনা। খুললে অবশ্য ফুটপাতের আলতু-ফালতুসহ সব জ্যোতিষীর ভাত মারা যাবে। তবে সাইড বিজনেস হিসেবে বিষয়টা মন্দ নয়।
আবুল মালের ‘রাবিশ তত্ত্ব’
আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় থেকে ‘স্বৈরাচারের দালাল’ বলে বিস্তর গালি খেয়েছেন তখন তার মুখ দিয়ে ‘উহ্’ শব্দটি বের হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে আওয়ামী লীগের তালেবর তারপর মন্ত্রীবর হওয়ার পর থেকেই তার জবান খুলে গেছে। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। এখন সেই খোলা জবান দিয়ে তিনি হামেশাই একে ওকে গালমন্দ করছেন। এর মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় গালিটি হলো ‘রাবিশ’।
এই গালি তিনি প্রথম চালু করেন শেয়ারবাজারে সর্বস্বান্ত হওয়া ৩৩ লাখ অসহায় লগ্নিকারীর বিরুদ্ধে। সরকারের অব্যবস্থা ও অপব্যবস্থায় যারা রাতারাতি সব কিছু হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হয়েছিল, সেই শেয়ার ব্যবসায়ীরা তার দৃষ্টিতে ছিল টোটালি ‘রাবিশ’। তাদের তিনি জুয়াড়ি বলতেও ছাড়েননি।
বোধ করি এই গালমন্দ বাধাগ্রস্ত না হওয়ার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এবার এই গালিবর্ষণ করেছেন ড. ইউনূসের ওপর। বলেছেন ড. ইউনূসের বক্তব্য ‘রাবিশ’। এরপর ‘সরি’ বলে আবার জোর দেন তিনি, যা বলেছেন এটাই ঠিক।
এক হাত দেখিয়েছেন তিনি হিলারি ক্লিনটনকেও। কারণ হিলারি বলে গেছেন, ‘আমি মুহাম্মদ ইউনূস ও তার কাজকে সম্মান করি। আমি আশা করি, তার কাজ অব্যাহত থাকবে এবং সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডে তা ব্যাহত হবে না। যদি হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক।’
আসলে বাংলাদেশ সফরকালে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে হিলারি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলে গেছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিরোধের বিষয়টি আমি ওয়াশিংটন থেকেই নজর রাখছি। আমি শুধু আশা করতে পারি, এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য খর্বিত হয়।’ এরপর ড. ইউনূস নাকি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার কথা বলেছেন।
ব্যস, আর যায় কোথায়? অর্থমন্ত্রী রেগে একেবারে টং। বলে বসলেন, হিলারির বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।
এখন কেউ যদি মুখ ফসকে বলে বসে, সবাইকে ‘রাবিশ’ বলে বলে তিনি নিজে একটা মূর্তিমান ‘রাবিশে’ পরিণত হয়েছেন। তাহলে উপায় কি?
সৈয়দ আশরাফের অভূতপূর্ব আবিষ্কার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের ঋণ কোনোদিন শেষ হওয়ার নয়। তার কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। অভূতপূর্ব দুটি অনন্যসাধারণ আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে অপার আনন্দে ভাসিয়েছেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রাপ্ত পর্যন্ত তার এই আবিষ্কারের আনন্দ ঢেউ খেলে খেলে বেড়াচ্ছে।
তার প্রথম আবিষ্কারের দুটি অংশ। প্রথমাংশে তিনি জ্ঞানতাপস ড. শহীদুল্লাহর চাইতেও দৃঢ়তা নিয়ে ড. ইউনূসের বেসিক সাবজেক্ট অর্থনীতি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘মাইক্রোক্রেডিট করলেন একজন কিন্তু অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পেলেন না। নোবেল পেলেন কোথায়? পেলেন শান্তিতে। কোন যুদ্ধে উনি শান্তি আনলেন? কোন মহাদেশে উনি শান্তি আনছেন?’
অর্থাত্ যুদ্ধ না থামালে শান্তি পুরস্কার পাওয়া যায় না। এই যে আবিষ্কার, এর দ্বিতীয়াংশে আছে আয়ারল্যান্ডের ‘মাদারল্যান্ড পিস’ নামীয় এক সংগঠনের দুই মহিলা নাকি সংগঠন করার দুই মাসের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পান শান্তিতে। তারপর টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দুই মহিলার মধ্যে ঝগড়া বাধে। তিন মাসের মধ্যে এই ঝগড়া আদালতে গড়ায়। শান্তির কর্ম কাবার। দ্বিতীয়াংশের এই আবিষ্কারটিও অসাধারণ। কারণ সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর অনেকেই নোবেল কমিটি ও আয়ারল্যান্ডে যোগাযোগ করে এরকম সংগঠন ও নোবেল পাওয়ার কোনো আলামত খুঁজে পাননি। কিন্তু তাতে কী? তাতে তো এই আবিষ্কারের মর্যাদা খাটো হয়ে যায় না!
সৈয়দ আশরাফের দুই নম্বর আবিষ্কারটি সত্যিকারের আবিষ্কার। আবিষ্কারের বাচ্চা আবিষ্কার। বাঘের বাচ্চা আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি চিরকাল বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। যে পুরস্কার পাওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় মানুষ মুখিয়ে থাকে, সেই নোবেল কীভাবে পাওয়া যায়, তা তিনি আবিষ্কার করে সবাইকে চমত্কৃত, বিস্মিত ও হতভম্ব করে ফেলেছেন। হার্টের জোর যাদের কম তাদের অনেকে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন। এমন একটা সামান্য বিষয় আমরা জানতাম না বলে বিশ্বের দেশে দেশে অনেক জ্ঞানীগুণী টেবিলে, দেয়ালে, ইলেকট্রিকের থাম্বায় মাথা আছড়াচ্ছেন।
এবার তার সেই মহান আবিষ্কারটি তুলে ধরছি। নোবেল কীভাবে আসে তা আমাদের এখানে অনেকেই জানেন মন্তব্য করে বলেছেন, ‘নোবেল কীভাবে দেয়া হয়, কীভাবে আসে, কেন দেয়া হয়—সে বিষয়ে আমারও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। বিশ্বের কিছু দেশ আছে যেখানে গিয়ে চিপস, স্যান্ডউইচ আর হোয়াইট ওয়াইন খেলে জনপ্রিয়তা বাড়ে। সময়মত নোবেল প্রাইজ পাওয়া যায়।’
সৈয়দ আশরাফের এই মহা মহা আবিষ্কারে আমার মতো অনেকেরই হয়তো দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল। কারণ তিনি শুধু আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি। বলেছেন, এ ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতাও আছে। কী আশ্চর্য, আমাদের হাতের কাছে, ঘরের ভেতরে এমন একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক আছেন তা এদ্দিন আমরা জানতেও পারিনি! পোড়া কপাল আর কাকে বলে!
দেশ, জাতি ও বিশ্ব মানবতার পক্ষ থেকে সৈয়দ আশরাফের কাছে আমাদের কাতর অনুরোধ, দোহাই আল্লাহর, এবার দয়া করে জানিয়ে দেন, কোন কোন দেশে গিয়ে চিপস, স্যান্ডউইচ আর সাদা মদ খেলে জনপ্রিয়তা বাড়ে, যা আখেরে জুটিয়ে দেবে নোবেল।
আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, দরখাস্ত—যে আবিষ্কার আপনি করে ফেলেছেন, তা বাংলাদেশের কল্যাণে উত্সর্গ করুন। বিশ্ব মানবতার সেবায় উত্সর্গ করুন। দয়া করে আপনি, ‘নোবেলপ্রাপ্তির সহজ উপায়’ অথবা নিজের নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘আশরাফিয়া নোবেলপ্রাপ্তির কোচিং সেন্টার’ খুলুন। আমরা যে যে দলই করি না কেন, সবাই মিলে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে আপনাকে সেই সেন্টারের ‘প্রিন্সিপাল’-এর চেয়ারে বসিয়ে মানবজনম সার্থক করবো।
আপনার সেই কোচিং সেন্টারে গিয়ে আমরা যারা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য পাগল, উন্মাদ, বেহুঁশ ও বেসামাল হয়ে আছি, তারা কোচিং নেব। তারপর দেশের শহরবন্দর, গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি বাড়িতে একটি করে নোবেল পুরস্কার ঢুকিয়ে দেশ ও জাতিকে ধন্য করবো।
প্লিজ চুপ করে থাকবেন না, কোন কোন দেশে গিয়ে ‘মাল খেলে’ নোবেল পাওয়া যায় তা আমাদের বলুন। আমরা সেইসব দেশে গিয়ে ‘মাল খাওয়া কাহাকে বলে এবং উহা কত প্রকার’ তা বিশ্বকে দেখিয়ে দেব। অবশ্য আরও একটা উপকার হবে, আমাদের আদম ব্যাপারীরাও উড়োজাহাজ, জাহাজ, ট্রলার, কনটেইনারের খোল ভরে ভরে বঙ্গসন্তানদের ওইসব দেশে পাচার করে টু-পাইস কামাতে পারবে। দেশের অর্থনীতিতেও তা কাজ দেবে।
আবার শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশিরাও আপনার কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য বেহুঁশ হয়ে ছুটে আসবে। তাতে আমাদের আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। প্রসার ঘটবে পর্যটন শিল্পেরও। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের সুনাম। আর ‘অমর’ হবেন আপনি।
দুই কান কাটা কাণ্ড : দিলীপের দড়াবাজি
বড় বড় মন্ত্রী-নেতাদের কারবার দেখে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া চুপ থাকেন কী করে? কুঁজোরও তো ইচ্ছে করে চিত্ হয়ে শুতে। ডান কান কাটা হাঁটে পথের ডান দিক ঘেঁষে। বাম কান কাটা হাঁটে পথের বাম ঘেঁষে। আর যার দুই কানই কাটা সে হাঁটে নাকি পথের মাঝ দিয়ে, বুক টান করে। অতএব মহাজোট সরকারের সঙ্গী বিশিষ্ট রাজনৈতিক এতিম, ‘তিন নম্বর বাচ্চা’ দিলীপ বড়ুয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেক নজরে পড়ার মওকা মিস করেন কী করে? ড. ইউনূসের গুষ্ঠি নিকাশের কাজে তিনি নাম লেখালেন।
এর আগে তিনি বলেছেন, উন্নয়নের ঠেলায় নাকি দেশে ফকির উঠে গেছে। সবাই সচ্ছল হয়ে গেছে। এই রাজনৈতিক সর্বহারা সারাক্ষণ থাকে পুলিশ আর অফিসারবেষ্টিত। তো তার আশপাশে ফকির আসবে কোত্থেকে। কিন্তু এই মন্ত্রী মহোদয়কে তা বোঝাবে কে? তিনি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় বুঝে নিলেন দেশে এখন আর ফকির নেই।
কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থানের সঙ্গে গাদ্দারি করে দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হয়েছেন। মান্নান ভূঁইয়া আর প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীরের দয়ায় যার নাকি জীবিকা নির্বাহ হতো। তিনি রাতারাতি মন্ত্রী বনে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেই পারেন। আবার বেগম জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে চীনও ঘুরে এসেছিলেন।
কিন্তু শিল্প দফতরের মন্ত্রী হওয়ার পরও তাকে নিয়ে কোথাও তেমন হৈচৈ নেই দেখে বোধ করি তার মন খারাপ থাকতো সবসময়। গ্রামেগঞ্জে একটা কথা আছে, পতিতার যখন বয়স বেড়ে যায়, সে হয়ে যায় খালা। কেউ আর তার দিকে তাকায় না। সঙ্গত কারণেই তার মন খারাপ থাকে। কেউ যাতে তার দিকে তাকায়, কেউ তাকে একটা গাল দেয়, সেই আশায় সে কি করে, পথের মাঝখানে মলত্যাগ করে। কোনো ব্যক্তি যদি অন্যমনস্কতাবশত সেই মলের ওপর পা দেয়, তো সে রেগেমেগে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করে। এই দৃশ্য আড়াল থেকে দেখে ‘খালা’ নাকি প্রাণ খুলে হাসে। বলে, যাক এখনও লোকেরা তাহলে আমাকে মনে রেখেছে।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া যিনি তিন-তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ১২০০-এর মতো। যার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে প্রতিবার, সেই ‘মহা জনপ্রিয়’ দিলীপ বড়ুয়া ড. ইউনূসকে ছুড়ে দিলেন কঠিন চ্যালেঞ্জ(!), ‘তত্ত্বাবধায়ক যদি এতই ভালো লাগে তাহলে রাজনীতিতে আসুন। রাজনীতিতে এসে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করে তারপর কথা বলুন।’—বুঝুন ঠেলা!
বেরসিক ব্যারিস্টার রফিক-উল হক
আমাদের কর্তাদের এইসব মন্তব্য, ভাষণ শুনে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মতোই বিরক্ত হন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার রফিক উল হক। তিনি গত ১২ মে এক আলোচনা সভায় বলেই ফেললেন, ‘একটি বড় দলের নেতা ও মন্ত্রী যদি মনে করেন শান্তিতে নোবেল পেতে হলে যুদ্ধ থামাতে হবে, তাহলে বোঝেন আমরা কত বড় বেকুবের দেশে আছি।’
দিলীপ বড়ুয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘তিনি ড. ইউনূসের নখের সমান হওয়ার যোগ্যও নন। একজন মন্ত্রী যদি বেকুবের মতো কথা বলেন তাহলে তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হয় না।’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের ওপর বলেন, ‘একজন মানি লোককে এভাবে অপমান করার চেয়ে আর জঘন্য কিছু হতে পারে না।’
ব্যারিস্টার রফিক উল হকের এই মন্তব্য প্রচারের পর অন্যরা খামোশ হলেও দিলীপ বড়ুয়াকে থামায় কে? তিনি তো সর্বহারা! তার তো মন্ত্রিত্বটুকু ছাড়া আর হারাবার কিছু নেই। সেজন্য আবার উচ্চকণ্ঠ হলেন। বললেন, ‘ইউনূসের মতো রক্তচোষা নই আমি।’
যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা যারা বলে তাদের চিহ্নিত করার জন্য বাংলা অভিধানে শব্দ আছে। সে সব শব্দ দিলীপ বড়ুয়ার ব্যাপারে ব্যবহার করলেই কি আর না করলেই কি? তার তো কিছু আসে যায় না।
সেজন্যই এই বেপরোয়া মন্ত্রী মহোদয় আবার বেপরোয়ার মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। তবে এবারের টার্গেট ড. ইউনূস নন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যারা টকশোতে অংশ নেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘টকশোধারীরা জেগে ঘুমান।’ তিনি তাদের ‘অন্ধ’ আখ্যায়িত করে বলেন, সেজন্যই তারা সরকারের উন্নয়ন দেখতে পান না।...তারা অদৃশ্য শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় বসতে চায়। তবে দেশের জনগণ তা হতে দেবে না।
উপসংহার
পর পর পাঁচবার ছেলে ফেল করেছে এসএসসি পরীক্ষায়। ষষ্ঠবার পরীক্ষার পর ছেলে যাচ্ছে রেজাল্ট আনতে। বাপ জব্বার মিয়া ডেকে বললো, শোন, এবার যদি ফেল করিস তাহলে ফিরে এসে আমাকে আর আব্বা বলে ডাকবি না। মনে থাকবে?
ছেলে মাথা নেড়ে বললো, জ্বি মনে থাকবে।
দুপুরে যথারীতি বিফল পুত্র বাড়ি ফিরে বাপকে খবরটা দেয়ার জন্য ডাকতে শুরু করলো, জব্বার মিয়া, ও জব্বার মিয়া—
রেগেমেগে ঘর থেকে বাইরে এসে জব্বার মিয়া ছেলেকে বললো, কিরে হারামজাদা, বাপকে নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিস...
ছেলে বললো, কী করবো, আপনিই তো বলে দিয়েছেন।
প্রিয় পাঠক, আমাদের ইউনূসবধ কাব্য দ্বিতীয় পর্বের এখানেই সমাপ্তি। আশা করি আমরা সবাই আগামী দিনগুলোকে চোখ মেলে দেখার জন্য আয়ু পাব।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ১২ মে, ২০১২

ভারতীয় আগ্রাসনের অন্তরলোক হারিয়ে যাওয়া হায়দারাবাদ


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র


দ্বাদশ পর্ব
হায়দারাবাদের ওপর ভারতীয় আক্রমণ শুরুর চতুর্থ দিন। হায়দারাবাদের অবনতিশীল পরিস্থিতি, নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা, বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়, মীর লায়েক আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার জন্য নিজামের আহ্বান এবং অফিসারশূন্য আর্মি হেডকোয়ার্টারের বর্ণনাই আজকের পর্বের উপজীব্য। যথারীতি মীর লায়েক আলীর স্মৃতিচারণই আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন :
ভারতীয় বাহিনীর হায়দারাবাদ আক্রমণ ক্রমেই আন্তর্জাতিক খবরে রূপ নিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হিসেবে খবরগুলো ছাপা হতে লাগল। প্যারিসে আয়োজিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যেখানে কিনা ভারত এবং হায়দারাবাদ উভয় দেশের প্রতিনিধিরা অবস্থান করছিল, সেখানে ভিড় জমল সাংবাদিকদের। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে দেখা গেল যে সাধারণ জনগণ ভারতের এই আচরণে ক্ষুব্ধ। এর প্রতিফলন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের জনগণের মধ্যে ছিল খুবই প্রবল। দেখার বিষয় এই হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, প্রায় সব দেশের মানুষের মধ্যে বিষয়টিকে ঘিরে যে অসন্তোষমূলক ভাব বিরাজ করছিল, তার প্রভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে কোনো দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিনা।
এ বিষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ প্যারিসে আসতে শুরু করল এবং নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত হায়দারাবাদের বিষয়টি নিয়ে সভা ডাকল, যা নির্ধারিত করা হলো ১৬ সেপ্টেম্বর। অন্তর্বর্তীকালে মঈন নেওয়াজ জঙ্গ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন পরিষদের সব সদস্যের সঙ্গে একজন একজন করে হায়দারাবাদ প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করে তাদের বোঝানোর জন্য। আলোচনায় দেখা গেল যে, চীন যারা কিনা ভারতকে সমর্থন করছিল এবং রাশিয়ার সদস্য বাদে অন্যান্য সব দেশের প্রতিনিধিরা ছিল ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ভারতের প্রতিনিধিরা রামস্বামীর নেতৃত্বে পর্দার আড়ালে থেকে যথেষ্ট সক্রিয়ভাবে তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছিল। শেষমেশ নিরাপত্তা পরিষদ কী সিদ্ধান্ত নেবে তখনও তা বলা যাচ্ছিল না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল যে, বেশিরভাগ সদস্যই ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিরিয়া, আর্জেন্টিনা এবং কানাডার প্রতিনিধিরা, সবাই ছিলেন ভারতীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে। ব্যতিক্রম ছিল চীন, যারা কিনা ভারতের পক্ষে কথা বলছিল এবং অন্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করছিলেন না।
এবার রণাঙ্গনের দিকে দৃকপাত করা যেতে পারে।
মুসী নদী পারাপারের সেতুটি ১৫ সেপ্টেম্বর উড়িয়ে দেয়ার আগেই সুরিয়াপেত থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে নদীর পশ্চিম তীরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হিমায়েত সাগর লেকের ফ্লাডগেট খুলে দেয়া হয় যাতে পূর্ব দিক থেকে আগত শত্রুপক্ষ সহজে সেতু পার হয়ে এগিয়ে আসতে সক্ষম না হয়। লেক এবং ব্রিজের মধ্যে দূরত্ব ছিল একশ’ মাইল এবং হিসাব করা হলো যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সেতুর কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন দিন। যে পরিমাণ পানি দরকার ছিল নদীর তীর ডুবিয়ে দেয়ার জন্য সে পরিমাণ গভীরতা সৃষ্টি করতে গেলে লেকটি প্রায় শুকিয়ে যাবে। ফলে এই অপারেশনটির কিছু ক্ষতিকর দিকও ছিল। আমি সেনাবাহিনীর প্রধানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ফ্লাডগেট খুলে রাখা কি খুবই জরুরি। তার বক্তব্য তখনও ছিল জোরালো যে নদীর তীর ভাসিয়ে দেয়া উচিত। তিনি জানালেন, সব নীরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের অবস্থান এখন নাকরাকালে। যাতে তারা সুরিয়াপেত ও দক্ষিণে মারিয়ালগুদা এবং নলদ্রাগ থেকে আসা শত্রুবাহিনীকে প্রতিহত করতে পারে। এতদসত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে ভাঙা সেতুটিতে কোনো প্রতিরক্ষা বাহিনী অবস্থান করছিল না। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই একটি সংবাদ এলো যে ভারতীয় বাহিনী ভাঙা সেতুটির স্থানে একটি অস্থায়ী সেতু বসাতে সক্ষম হয়েছে। তারা এগিয়ে আসছে। তখন সেনাপ্রধান বলল যে তাদের উচিত ছিল পশ্চিম তীরে কিছু নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা, যাতে তারা সেতু স্থাপন কাজে ভারতকে বাধা দিতে পারত। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলাম যাতে হিমায়েত সাগর লেকের ফ্লাডগেট বন্ধ করে দেয়া হয়। হতাশার সঙ্গে সেনাপ্রধানকে বললাম, নাকারাকালের পূর্ববর্তী পাহাড়ি এলাকায় যতদূর সম্ভব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য।
১৬ সেপ্টেম্বরের সকালে ভারতের মূল বাহিনী বিদার ছাড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। দুপুরের মধ্যে তারা বিদার-জহিরাবাদ রাস্তা ধরে এগুতে লাগল। ততক্ষণে নিরাপত্তা বাহিনীর এক অংশ এবং টুয়েন্টি ফাইভ-পাউন্ডার বন্দুক এগুলো, যেগুলো কিনা পূর্বে হুমনাবাদে অবস্থান করছিল, সেগুলোকে সরিয়ে জহিরাবাদের পেছনে অবস্থান করানো হলো। এগুলো ছিল একজন ব্রিগেডিয়ারের কমান্ডের অধীনে। যাকে কিনা বিদারে অবস্থান করানো হয়েছিল। তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল পাহাড়ি এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। এবং একজন সৈন্য জীবিত থাকা পর্যন্ত সেই স্থানের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। হুমনাবাদ থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশিরভাগ অংশই সরিয়ে আনা হয়েছিল ভারতীয় মূল বাহিনীর বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। জহিরাবাদের ভৌগোলিক অবস্থা ছিল হুমনাবাদের মতোই ভালো। আশা করা হচ্ছিল যে, সঠিক সঠিক স্থানে সৈনিকদের দাঁড় করাতে পারলে ভারীধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
আমি একবার সকালে এবং পরে দুপুরে নিজামের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। তার মধ্যে যোগাযোগে অনিচ্ছুক একটা ব্যাপার কাজ করছিল। আগের দিন দুপুরে বেতার মাধ্যমে আমি ভারতের নেতাদের উদ্দেশ করে যে বার্তা সম্প্রচার করেছিলাম, তার কোনো জবাব দিল্লি থেকে সম্প্রচারিত কোনো মাধ্যমে আসছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখে নিজাম ধরেই নিয়েছিলেন, ভারতীয়রা আমার সম্প্রচারে সাড়া দেবে না। তিনি এ বিষয়েও একমত ছিলেন যে, এখন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো সেনাপত্যপূর্ণ বা রাজনৈতিক কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পাকিস্তান কি তখন এটা বুঝতে পারছিল না যে, যেহেতু ভারতের সিংহভাগ সামরিক শক্তি হায়দারাবাদে ব্যস্ত, সেই সুযোগে তাদের সামরিক বাহিনী অন্ততপক্ষে পাথানকোট-জম্মু রোড এবং সেতুর পুরোভাগ নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে পারে? যার ফলে পুরো কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যাবে। যাতে করে সেখানকার পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে চলে আসবে। এটার ফলে পাকিস্তানের অনেক সুবিধা হবে। নিজাম আমার সঙ্গে একমত হলেন। কিন্তু তাতে করে হায়দারাবাদের কোনো সুবিধা হবে না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে জিন্নাহর মৃত্যুর পর এত দ্রুত এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত কেউ নেই। আমিই একমাত্র কিছুটা আশাবাদী ছিলাম; আমি আশা করছিলাম যে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কোনো একটা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু নিজাম আমার সঙ্গে একমত ছিলেন না।
মন্ত্রিসভার একটি আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো পরিস্থিতি বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে এবং ধারণা করা হচ্ছিল যে নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। আশা এবং হতাশার একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া মন্ত্রিসভায় উপলব্ধি করা যাচ্ছিল। সবাই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের জন্য যা কিনা সেদিন বিকালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, সেখানে কী সিদ্ধান্ত নেবে তা নিয়ে। প্যারিস থেকে আসা সব সংবাদ যাতে করে সেনাপ্রধানের কাছে পৌঁছে যায় এবং এই মারাত্মক পরিস্থিতিতে তার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তাকে ভালোভাবেই জানিযে দেয়া হয়েছিল।
খবর এলো যে ভারতীয় বাহিনীর দক্ষিণভাগ এগিয়ে আসছে এবং তারা পূর্ব দিক থেকে অগ্রসর না হয়ে পশ্চিম দিকে মুখ নিয়েছে। তখন পর্যন্ত বলা যাচ্ছিল না যে তারা কি নলদ্রাগ হয়ে মূল ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হবে, নাকি তারা পশ্চিমেই এগোতে থাকবে এবং দিওয়ারকোন্দ-হায়দ্রাবাদ রোডে গিয়ে উঠবে। ওই এলাকায় কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। আমি ঠিক করলাম যত দ্রুত সম্ভব রাজাকারদের একটি বাহিনী সেখানে পাঠাব। তাদের কিছু সুদক্ষ আর্মি অফিসারের আওতায় এনে সেখানে পাঠালে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাদের খাদ্য, যাতায়াত এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থার দায়িত্ব দেয়া হলো কিছু বেসামরিক কর্মকর্তার হাতে, যারা প্রশংসনীয়ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু কোনো ভারতীয় বাহিনী সেই অঞ্চলের দিকে এগুল না।
হায়দারাবাদের সেনাদের কাছে স্বল্পসংখ্যক ট্যাংক-মাইন ছিল এবং আমি আদেশ দিলাম সেগুলোকে জহিরাবাদ— হায়দ্রাবাদ রোড এবং নাকরাকাল-হায়দ্রাবাদ রোডে সুপরিকল্পিতভাবে পুঁতে রাখার জন্য। সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ আগেই সব রাস্তার, যেসব স্থান দিয়ে ট্যাংক আসতে পারে, সেখানে মাইন পুঁতে রাখার মানচিত্র প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। এক আদেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা কাজে লেগে গেলেন। পরদিন সকালের আগেই কাজ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হলো।
কাজ এতই বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন সময় বুঝি উড়ে চলে যাচ্ছে। নিজামের কাছ থেকে খবর এলো এবং তিনি যখন সম্ভব তার সঙ্গে আমাকে দেখা করার জন্য বলেছিলেন। আমি এরই মধ্যে দুইবার তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলাম। তার সঙ্গে তৃতীয়বার সাক্ষাত্ করার সুযোগ পেতে পেতে অনেক বিকাল হয়ে গেল। তবে পূর্ববর্তী সাক্ষাত্গুলোতে তাকে যেমন মনভোলা এবং উদাস দেখাচ্ছিল তার চাইতে অনেক ভালো দেখাচ্ছিল। আমি পরিস্থিতির সব তথ্যউপাত্ত তার সামনে পেশ করলাম। তার সঙ্গে আধ ঘণ্টা পর পর সেনাপ্রধানের যোগাযোগ হচ্ছিল। এবং আর্মি কমান্ডার তাকে সম্প্রতি ঘটিত সব তথ্য দিয়ে আপডেটেড রাখছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেই আমি তাকে জবাব দিলাম যে প্যারিসের সময় আমাদের সময়ের চেয়ে পাঁচ ঘণ্টা পিছিয়ে এবং তাদের বৈঠক আরম্ভের আরও চার ঘণ্টা সময় বাকি আছে। তাকে জানালাম যে প্যারিসের কাছ থেকে খবর পেতে পেতে পরদিন সকাল হয়ে যাবে। কথাটি শুনে তিনি কিছু সময় চুপ হয়ে রইলেন। আমিও চুপ থাকলাম। তিনি আমাকে বললেন, আমার সব হিসাবই ভুল। পাকিস্তান নিশ্চুপ দর্শক হয়ে বসে আছে। আমাদের সৈন্যরা হতাশাজনকভাবে যুদ্ধ করছে। অপরদিকে ভারতীয় বাহিনী ধেয়ে আসছে রাজধানীর দিকে। নিরাপত্তা পরিষদের কোনো খবর নেই। তিনি তখন বুঝতে পারলেন যে তার এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা এখন বিপর্যস্ত প্রায়। তিনি আমাকে বললেন সময় এসেছে আমার সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করার। তিনি বললেন, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। সামনে পথ কেবল দুটি। প্রথমটি হলো আমি এবং আমার দ্বারা শাসিত সরকার ঘোষণা দেবে যে তারা রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব তাদের হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে। তখন তিনি সব দায়িত্ব নেবেন তার হাতে। তিনি তখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখবেন কী করা যায়। যতদূর সম্ভব ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে বৈঠক করে কিছু একটা করবেন। অথবা আমি যদি একমত না হই তবে তিনি তার সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন, যা কিনা তখন আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভারতের সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির কথা কি তিনি বিবেচনা করছেন? তিনি আমাকে শুধু এতটুকুই বললেন যে, তিনি তার বিচক্ষণতার আশ্রয় নেবেন। পরিস্থিতি বিবেচনার যতটুকু সম্ভব রক্ষার চেষ্টা করবেন। তিনি আরও কিছু বলে আমাকে বললেন নয়টার মধ্যে আমার মতামত তাকে জানাতে। যা কিনা হবে সুস্পষ্ট এবং চূড়ান্ত। আমি তাকে জানালাম যে, আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত ওই সময়ের মধ্যে দিতে পারব। কিন্তু সরকারি বিষয় এটা, সেহেতু রাত দশটা নাগাদ মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক আয়োজন করে পরেই তাকে অফিশিয়াল মতামত দিতে পারব। আমার কথায় তাকে একটু হতাশ দেখাল। কিন্তু তিনি রাজি হলেন শেষমেশ।
নিজামের সাথে সাক্ষাতের পর আমি বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম, আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েনিলাম যে, যাই ঠিক করব তা হবে বাস্তবসম্মত। নিজামকে ছাড়া পরিস্থিতির কী হবে তা নিয়ে ভাবলাম এবং ভেবে পেলাম যে পরিস্থিতি নিজামকে ছাড়া আরও দ্বিগুণ খারাপ হয়ে যাবে। সেরকম পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর কী হবে এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া কেমন হবে? আমি কি নিশ্চিন্তে পূর্ণ আস্থার সঙ্গে তার সঙ্গে বিষয়াদি নিয়ে শলাপরামর্শ করতে পারব? এসব বিষয়ই আমার মাথার মধ্যে তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কোনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তখনও পর্যন্ত কোনো অগ্রগতির খবর এসে আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেনি। সেনাপ্রধান কিছু সময়ের জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। এবং সেই সময় একজন স্টাফ অফিসারের সঙ্গে আমার কথোপকথন হলো। কথা বলে জানতে পারলাম যে তাদের সবার ধারণা এই যে, বর্তমান ধারার পরিস্থিতি যে গতিতে এগুচ্ছে, সেভাবে এগুতে থাকলে, আমাদের রাজধানীতে ভারতীয় বাহিনীর পৌঁছাতে অন্ততপক্ষে তিন দিন লাগবে। জানতে পারলাম যে তারা সবাই নিরাপত্তা পরিষদের কাছ থেকে কী আশা করা যায় তা জানতে আগ্রহী।
আর্মি কমান্ডার শিগগিরই ফিরে এলেন। জানালেন যে পূর্বদিকে আমাদের বাহিনী খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। যত দ্রুত আশা করা হয়েছিল তারচেয়েও দ্রুততরভাবে ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে আসবে। তা পশ্চিম থেকে না হয়ে হবে পূর্ব থেকে। কাসেম রাজভীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হলো এবং তিনি জানালেন যে এখন পর্যন্ত এক হাজার রাজাকার আছে আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমি সব রাজাকার এবং স্বেচ্ছাসেবক অসামরিক বাহিনীকে আদেশ দিলাম পূর্ব দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেতে। শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য সেখানে মাইন পুঁতে রাখতে এবং বিভিন্ন স্থানে গর্ত খুঁড়ে রাখতে, যার পরিকল্পনা আগে থেকেই করে রাখা হয়েছিল। এরপর আমি আর্মি কমান্ডার এবং তার স্টাফদের কাছ থেকে সেনা মোতায়েনের সুনির্দিষ্ট খবরাখবর নিলাম। পূর্বে জহিরাবাদের পাঘড়ি এলাকায় নতুন এইসব প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে এবং তারা একজন ব্রিগেডিয়ারের আওতায় কাজ করবেন; যিনি কিনা পূর্বে বিদারের যুদ্ধময়দানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আর্মি কমান্ডার তার কাজকর্ম দেখে সন্তুষ্ট ছিলেন। তার সংবেদনশীলতা প্রশংসার যোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
সব ডিফেন্ডিং ইউনিটকেই টিনের কৌটায় ভরা খাবারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল যুদ্ধের শুরু থেকেই। তাদের গরম টাটকা খাবার সরবরাহ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল। অসামরিক কিছু স্বেচ্ছাসেবকের তত্ত্বাবধানে তাদের টাটকা খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
আমার নিজের জন্য সামান্য সময় দরকার ছিল, নিজাম আমাকে যা বলেছেন তার একটি জবাব তাকে দেয়াটা ছিল জরুরি। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগের সময়ই বের করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে জানতে পারলাম যে মুসতাক আহমেদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু গোপন সংবাদ ডিকোড করা হয়েছে, যা আমার জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থায় আছে। শাহ মঞ্জিলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যেখানে ডিকোডেড সংবাদ আমার জন্য রাখা ছিল, সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম যে নিজাম আমাকে তিনবার ফোন করেছিলেন। নিজাম আমাকে খুব জরুরিভাবে দেখা করতে বলেছেন। মুসতাক আহমেদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মেসেজটির ওপর একবার চোখ বুলিয়েই আমি নিজামের সঙ্গে দেখা করার জন্য রওনা দিলাম। ভাবছিলাম আমাকে বলার তার আর কিই-বা বাকি আছে।
সত্যিই তার আমাকে বলার তেমন কিছু ছিল না এবং তার জবাবে আমারও বলার তেমন কিছুই ছিল না। আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে দুবার আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে তথ্য আসে যে যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমাদের কথা বলার মাঝে কয়েকটি বিমান বেশ নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। বিমানগুলো ভারতীয় বাহিনীর, নাকি আমাদের সরবরাহকারী বিমান বুঝতে পারছিলাম না। এরপর শুনতে পেলাম নিজামকে রক্ষাকারী বাহিনীর ব্রেনগানের আওয়াজ। নিজেদের বিমানের দিকেই আবার গুলি চালানো হচ্ছে কিনা ভেবে অস্বস্তি অনুভব করছিলাম।
নিজামের সঙ্গে বক্তব্য সেরে আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা হলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম যে নিজাম বিকালে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে আমার মতামত চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি কৌশলে সেই বিষয়টি এড়িয়ে সেখান থেকে বিদায় হলাম। নিরাপত্তা পরিষদের মতামত তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাব, একথা দিলাম।
নিজামের সঙ্গে এমন ব্যবহার আগে কখনও আমার দ্বারা হয়নি। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু ওই বিষয় নিয়ে আলাপ করে আবেগময় হয়ে ওঠার সময় আমার হাতে ছিল না মোটেই। আর্মি হেডকোয়ার্টারে এসে দেখলাম সেটা আর আর্মি অফিসারদের জমায়েতস্থল হিসেবে টিকে নেই। সেখানে ছিল শুধু কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত অসামরিক ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন সরবরাহের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত ছিল এবং পূর্বে আলোচিত বিষয়গুলো নিয়েই আবারও আলোচনা করছিল। কাসেম রিজভী ব্যস্ত ছিল তার রাজাকার সদস্যদের ঠিকমত ঠিক গন্তব্যে পৌঁছান নিয়ে। এবং তার একটু পর পর আমার অভিমত নিচ্ছিলেন। তিনি সামরিক অবস্থা নিয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। কিন্তু তাকে মোটেও ভীত দেখাচ্ছিল না। আত্মবিশ্বাস নিয়েই তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
a_hyesikder@yahoo.com