সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আবার তোরা মানুষ হ


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

‘তোমার চোখের মতো স্নিগ্ধ চোখ পৃথিবীতে নেই,
এবং কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র
আর প্রসব করেনি এই পৃথিবীর বুকে’
—কবি হাসান বিন সাবিত।
[রসুলের সাহাবী]

‘বালাগাল উলা বে কামালিহি

কাশাফাদুজা বে জামালিহি
হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
—শেখ সা’দী।

‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়,

রূপ-কাঠের নৌকা খানি
নাহি ডোবার ভয়।

নবী না চেনে যারা

মুয়াহেদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার তাই মজুরী
দলিলে সাফ দেখা যায়।’
—লালন ফকির।

‘দেখ ঐ গিরি প্রস্রবণ আনন্দে উজ্জ্বল

যেন তারার এক চমক, মেঘের উপরে
পালে তারে তরুণ বয়সে সদয় আত্মিকগণ
চূড়াগণ মধ্যবর্তী ঝোপের মাঝারে।’
—গ্যাটে।
[হজরত মুহম্মদ গীতি]।

“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some reader’s and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular level.”

ÑMichael H Hart
[The 100 : A Ranking of the most influential persons in history]

[ বশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় আমি যে মোহাম্মদকে প্রথমে রেখেছি তাতে কিছু পাঠক বিস্মিত হতে পারেন, কেউ কেউ প্রশ্নও তুলতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ইহজাগতিক উভয় স্তরে সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছেন।’


—মাইকেল এইচ হার্ট। [দি ১০০ : এ র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পার্সনস ইন হিস্টরি]


‘আমি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিশ্চিত হয়েছি যে, সেই কঠিন সময়ে ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল তরবারির মাধ্যমে নয়, বরং তার সরলতা ও ইসলামের নবীর নম্রতার মাধ্যমে। তাঁর অঙ্গীকার পূরণের দৃঢ়তা, তার বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য তাঁর মমতা, তাঁর নির্ভীকতা, সাহস, সৃষ্টিকর্তা এবং নিজের কাজের ওপর আস্থা। তরবারি নয় বরং এসবই ছিল আসল কারণ। যার দ্বারা তিনি প্রতিহত করছিলেন সকল ধরনের বিপদ।’

—মহাত্মা গান্ধী।
[Young India, 1924]|

‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ,

সেই পথে মোর চলে যেতেন নূরনবী হযরত।

পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,

আমি, ঝরনা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে,
সেথা, দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত\’
—কাজী নজরুল ইসলাম।

ওপরের উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করলাম ইচ্ছে করে। কারণ আমার হৃদয় বেদনায় জর্জরিত। আমার বোধশক্তি তিরোহিত। আমি হতবাক, আমি স্তম্ভিত। আমি আতঙ্কিত। এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাসে রাসুলের (সা.) চরম শত্রুরা যা কখনও কল্পনাও করেনি, সালমান রুশদির মতো সাম্রাজ্যবাদের গৃহপালিত লেখকও যে ভাষা ব্যবহার করতে সাহস পায়নি, এমনকি ধর্মান্ধ ক্রুসেডাররাও যে ভাষা ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ করেছে, তার চাইতেও নোংরা, জঘন্য, অশ্লীল, হিংস্র ও অসভ্য ভাষা ব্যবহার করেছে রাজীবসহ আরও কয়েকজন ব্লগার। যারা ব্লগার নামেরও কলঙ্ক। ডধত্ ডড়ষভ-এর মতো জিঘাংসা নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাসুলের পবিত্র নামের ওপর। আশ্চর্যের বিষয় এদের কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নয়, সবাই মুসলমান অথবা মুসলিম পরিবারের সন্তান। এদের কেউই এলিয়েন নয়, কোনো জন্তু-জানোয়ার নয়। এরাও মানুষ! কোনো না কোনো নারীর জঠরে এদের জন্ম।

এরা যদি মানুষ হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষ শব্দটি তার তাত্পর্য হারিয়ে ফেলেছে। এরা যদি নাস্তিক হয় তাহলেও বুঝতে হবে এরা ভণ্ড নাস্তিক। এরা নাস্তিক হওয়ারও অযোগ্য। কারণ নাস্তিক্যবাদও এক ধরনের বিশ্বাস। একটা বিশ্বাস কখনোই অন্য একটি বিশ্বাসকে আহত করে না, অপমান করে না। এ প্রসঙ্গে মনীষী আহমদ শরীফের (যিনি একজন খাঁটি নাস্তিক ছিলেন) উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না—‘নাস্তিক হওয়া সহজ নয়।...তাই প্রাচীন ও আধুনিক দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত নাস্তিকই ছিলেন সুজন, সুনাগরিক ও মনীষী।’ রাজীব এবং তার সহচররা তো এই কথার ধারে-কাছেরও কেউ নয়। ওরা তো বন্য বরাহের চাইতেও দাঁতাল এবং কুিসত। চ্যানি বলেছেন, যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারাই যুবক। যারা ধর্মে অবিশ্বাসী তারাই বৃদ্ধ। তাহলে এরা যুবকও নয়, বৃদ্ধও নয়, এরা কদর্য-কোনো প্রাণী। যাদের উদ্দেশ্য হলো দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনা। হানাহানি ডেকে আনা। রক্তপাত ডেকে আনা।
ধর্ম হলো মানুষের গভীরতম, নিবিড়তম এক বিশ্বাস। তার সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান। সেই জায়গায় যেমন অন্যের প্রবেশাধিকার নেই, তেমনি তাকে অসম্মান করার অধিকারও কারও নেই। এজন্যই রবার্ট বার্টন বলেছেন, ‘ধর্ম মানব মনীষা আর উপলব্ধির এক দুর্লভ কৃতিত্ব আর সম্পদ। ধর্মের কাছে মানুষ পায় আত্মজ্ঞান, অতীন্দ্রিয় জিজ্ঞাসার প্রেরণা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধার শান্তি ও সান্ত্বনা। ধর্ম মানুষকে দেখিয়েছে বিশ্বাস, ভক্তি, বিনয়, ক্ষমা, করুণা আর আত্মনিবেদনের পথ, দিয়েছে শৃঙ্খলা আর সংযত জীবনের দীক্ষা।’ সেই স্থানে ড্রাকুলার মতো, শয়তানের মতো, গোঁয়ারের মতো আঘাত করেছে সরকারের নিয়োজিত হাতে-গোনা কয়েকজন ব্লগার।
আসলে এরা ব্লগার নয়, ব্লগারের ছদ্মবেশ পরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী।
পৃথিবীর দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের রাসুলকে করেছে চরম অপমান এবং তা এমন একসময় যখন সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র, রক্তপিপাসু ইসরাইল এবং আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাস, ভীতি এবং আতঙ্ক। উদ্দেশ্য ইসলাম নির্মূল।
সঙ্গত কারণেই এইসব তথাকথিত ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এরা এদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছে সম্প্রীতি, সমঝোতা ও শান্তির বিরুদ্ধে। উস্কে দিতে চেয়েছে আগুন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে বাংলাদেশকে। আর এদের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে একটি ব্যর্থ, অযোগ্য, অপদার্থ সরকার ও তাদের পা-চাটা গণমাধ্যম। যারা হারিয়ে ফেলেছে পেশাদারি সততা। সরকারের মতোই এরাও সাইকোপ্যাথ। যারা অন্ধের মতো সবকিছুর মধ্যে জামায়াত-শিবির খুঁজে বেড়ায়। আর চেপে যাচ্ছে সত্যকে।

দুই

আমাদের নেতা তখন আতিকুর রহমান সালু। পূর্ব পাকিস্তান বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের তিনি তখন সাধারণ সম্পাদক। সালু ভাই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির স্থপতি। আর আমি বলছি ষাটের দশকের শেষ দিককার কথা। সুদূর ভূরুঙ্গামারী থেকে রংপুর এসেছি তার এক জনসভায় যোগ দিতে। ফেরার পথে জড়িয়ে গেলাম হাঙ্গামায়। তখন তো বাহন বলতে কেবল ট্রেন। সেই ট্রেনে আমাদের কামরায় উঠলো ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা প্রথম থেকেই মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে আজেবাজে ভাষায় আক্রমণ শুরু করে দিল। আর মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ তখন আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা। আমরা অনুরোধ করলাম বাজে কথা না বলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা অশ্লীল ভাষার ব্যবহার থেকে বিরত হলো না। শুরু হলো প্রতিআক্রমণ। তারপর যা হয়। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। হাতাহাতি থেকে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। ট্রেনের যাত্রীরা ভয়ে চিত্কার শুরু করে দিল। থেমে গেল ট্রেন। ছুটে এলো গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ। তারাও থামাতে পারে না। এর মধ্যে ছাত্রলীগের দুই-তিন জনের মাথা ফেটে গেল। আমাদেরও কেউ কেউ রক্তাক্ত।
রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল করার জন্য যদি এত বড় কাণ্ড ঘটতে পারে, তাহলে ধর্মকে অপমান করলে, নবী, অবতারদের অপমান করলে কী ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
শুধু মুসলমান বলে কথা নয়, হিন্দুদের দেবদেবী, খ্রিস্টানদের যিশু কিংবা বৌদ্ধদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেও তারা একই রকমভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে পারে। এই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, যত ক্রুসেড হয়েছে অন্য কোনোকিছু নিয়ে এত নয়। ভারতে এখনও দাঙ্গাহাঙ্গামা নৈমিত্তিক ব্যাপার। এজন্যই অন্য ধর্মের লোকদের গালমন্দ করার ব্যাপারে কোরআন শরীফে নিষেধাজ্ঞা আছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ করো না। তাহলে তারাও ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে।’ [সুরা আল-আনয়াম]।
বলা হয়েছে ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ [ধর্মের বিষয়ে জোর-জবরদস্তি নেই]। হাদিসে আছে রাসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করবে, তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, কিংবা তাকে সাধ্যাতিত পরিশ্রম করাবে, তার অমতে তার কিছু ছিনতাই করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার প্রতিপক্ষ হবো।’
ইসলাম বলে, ‘অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করবে না। যদি তর্কবিতর্ক করতেই হয়, তাহলে তা করো উত্তম পন্থায়।’
আমি পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চাই আমি কোনো ধর্মবেত্তা নই। ইসলামী চিন্তাবিদ নই। সেই অর্থে প্র্যাকটিসিং মুসলিমও নই। তারপরও ইসলামের বিশ্বজনীন বাণীর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ প্রগাঢ়। সেজন্যই পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি, ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি সম্মানবোধ লালন করি অন্তরে। বিশ্বাস করি কোনো ধর্মই বিদ্বেষ ও হানাহানি নয়, মানুষে মানুষে প্রেম ও শান্তিকেই দিয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব।
ব্লগার রাজীবের অন্যায় ও অন্যায্য কাজ এবং তার সহচরদের সহযোগিতা, বাংলাদেশের মানুষের মতো আমাকেও ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত করেছে। বিশেষ করে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তারা যা লিখেছে তা এককথায় ক্ষমাহীন। সেজন্যই দেশজুড়ে জ্বলে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। ধর্মপ্রাণ মানুষজন পথে নেমেছে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে নয়, তারা পথে নেমেছে অপমানের বিরুদ্ধে, তাদের দাবি একটাই—এই ঔদ্ধত্য অবশ্যই দেশ, জাতি, ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে, কল্যাণ ও মঙ্গলের স্বার্থে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সময় ক্ষমতাসীন আছে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার, যারা এই ধর্মবিদ্বেষীদের পক্ষ অবলম্বন করে ধর্মপ্রাণ মানুষদের শায়েস্তা করার জন্য নামিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ তাদের দলীয় ঠাঙ্গারেদের। হামলা মামলায় জেরবার করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি শাহবাগের চত্বরের জমায়েতকে সামনে নিয়ে বিরোধী গণমাধ্যম বিশেষ করে আমার দেশ ও তার সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভির বিরুদ্ধে একের পর এক ছাড়ছে রণহুঙ্কার। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে জটিল কুটিল আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র। নতুন করে দেয়া হয়েছে মামলা। তিনি নাকি উস্কানি দিচ্ছেন। মাহমুদুর রহমান তো খবর ছাপিয়েছেন মাত্র। যারা উস্কানিদাতা তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। কিন্তু উস্কানিদাতাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে এখন উল্টো অভিযোগ চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের ওপর। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই রকম বিষোদগার ১৯৭৫ সালের পর আর এদেশে দেখা যায়নি। এখন দেয়া হচ্ছে আল্টিমেটাম, গ্রেফতারের হুমকি। শাহবাগের নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগের ক্যাডারদের পাশাপাশি এখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরাও স্বমূর্তি ধারণ করে বকছেন আবোল-তাবোল।
সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললে যে কাউকে পেতে হচ্ছে কঠিন দণ্ড। ঘটছে চাকরিচ্যুতি। এখন বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়ে পড়ছে ফালতু বিষয়। আর মহানবী (সা.)কে অপমান করলে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করলে পাওয়া যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। মহানবীর গালমন্দকারীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী উপাধি দেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’। তড়িঘড়ি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাতকারীর বাসায়। জানান সহানুভূতি। আর যারা ধর্মের অপমানের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। তাদের হত্যা করা হচ্ছে। কুকুর ও সাপের মতো তাদের পেটানো হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসাগুলো।
আধিপত্যবাদের তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলোও সরকারের পাপিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে কোরাস। তারা সাংবাদিকতা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীদের মতো জুলুমকারীকে বানাচ্ছে বীর। আর নির্যাতিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে অপপ্রচার। তাদেরকেই করছে দোষারোপ। সরকার এবং এই গণমাধ্যম পরিস্থিতিকে শান্ত করার বদলে উল্টো অপরাধীদের উস্কে দিচ্ছে আরও সহিংস হওয়ার জন্য। ধর্ম এবং আদালত দুটোরই এখন লাঞ্ছনার শেষ নেই এদেশে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমার দেশ যে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে, তার প্রশংসা করার বদলে তারা এখন পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর তাদের কর্কশ কণ্ঠকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
সঙ্গত কারণেই যে কারও পক্ষেই এই ধারণায় উপনীত হওয়া সহজ যে, সরকার ইসলাম ধর্ম এবং বিরোধী গণমাধ্যমকে পিষে মারার জন্য অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরকে দমন করার উসিলায় তারা আসলে দমন করতে চাচ্ছে সব বিরোধিতাকে। জামায়াত-শিবির দমন হলো তাদের উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়া। দেশকে ভেতর থেকে অকার্যকর করে দেয়া। সে জন্যই তাদের কাছে এ বিষয় স্পষ্ট যে শাহবাগ চত্বরের জমায়েত হচ্ছে তাদেরই ইচ্ছায়। তাদেরই নির্দেশে। সরকারি নানামাত্রিক ষড়যন্ত্রেরই একটি পর্যায় হলো শাহবাগ। সেজন্যই আজ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে কুত্সা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বলা হচ্ছে রাজাকার। শাহবাগ চত্বরের এমরান জাতীয় দলীয় লোকদের হম্বিতম্বি, নাসিরউদ্দিন ইউসুফদের আস্ফাালন ছাড়িয়ে গেছে মাত্রা। আর প্যান্ট খুলে গেছে সরকারের। সরকার ও শাহবাগ এখন একাকার।
সরকার ব্লগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করে তাদের লেলিয়ে দিয়েছে দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সব ধর্মবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে ডেকে আনছে সহিংসতা। ডেকে আনছে রক্তপাত।
সেজন্যই তাদের দলবাজ বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় হয়েছে অবতীর্ণ। ফলে নিজেদের বেলায় গণতন্ত্র, ১৭ দিন ধরে শাহবাগ দখল করে রাখলেও তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ একদিন মিছিল করলেই তা কবিরা গুনাহ হয়ে যায়। চমত্কার বাকশালী গণতন্ত্র!

তিন

ব্লগার রাজীব কিংবা তার দুষ্কর্মের দোসরদের দোষ দিয়ে সস্তা হাততালি পেতে চাই না আমি। দোষ তো বীজের। দোষ তো পরিবারের। দোষ তো বাবা-মা’র। দোষ তো সমাজের। দোষ রাষ্ট্রের। দোষ রাজনীতির। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। দোষ আমাদের পরিবেশের।
আমরা তো আমাদের সন্তানদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। যথার্থ শিক্ষা দেইনি। ব্যর্থ পিতামাতার ব্যর্থ শিক্ষা এবং ব্যর্থ রাজনীতির জরায়ু থেকে তো ভালো মানুষ জন্মানোর কোনো পথ নেই। ভালো মানুষ জন্মাতে পারে না। পারে না বলেই জন্ম হচ্ছে রাজীবের মতো, বাপ্পাদিত্যের মতো বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন সন্তানদের।
সেজন্যই অনুরোধ করি, আসুন জাতীয় জীবনের এই চরম দুর্যোগের দিনে, আমরা আমাদের সন্তানদের আবার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেই। ফিরিয়ে আনি হারিয়ে যাওয়া নীতি ও নৈতিক শিক্ষায়। তাদের স্বর্ণগর্ভ অতীত সম্পর্কে জ্ঞাত করাই। বর্তমানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করি। নিশ্চিত করি অনাগত ভবিষ্যত্। রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করি দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন দেশপ্রেম বর্জিত অসত্, ভণ্ড, প্রতারক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের। তাদেরকেও মাও সেতুঙের মতো, স্টালিনের মতো সংশোধনাগারে পাঠিয়ে আবার মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেই। জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরের মতো এই দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সরকারের লোকজনদেরও ধরে ধরে শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেখতে বাধ্য করি খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছায়াছবি।
কেবল তাহলেই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে শ্রেয়বোধগুলো। ফিরে আসবে মহত্ত্ব। নইলে নব্য বাকশালীদের জিঘাংসা গিলে খাবে আমাদের সব অর্জন। গিলে খাবে দেশটাকে।
a_hyesikder@yahoo.com

রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ নাটক


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র




ছাত্রশিবিরের আন্দোলন মোকাবিলায় বেসামাল সরকার যখন হিটলার কিংবা চেঙ্গিস খানের মতো নৃশংসতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করছে ছেলেদের, তুলে নিচ্ছে চোখ, পশুর মতো পিটিয়ে করে দিচ্ছে বিকলাঙ্গ, তখন সেসব নিয়ে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না শাসকরা। তারা বাংলাদেশের মানুষের গণদাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পদ্মা সেতু কিংবা হলমার্কের মতো পাহাড় সমান ইস্যুগুলোকে পাথরচাপা দিয়ে, নিজেদের দূষিত মুখ ডিসটিলড ওয়াটারে ধুয়ে ফের বীর হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য একাত্তরের শত্রু উচ্ছেদের নামে নয়া এজেন্ডা সামনে ঠেলে দিয়েছে। এ কাজে ব্যবহার করছে ডাণ্ডাবাজ ছাত্রলীগ, পেটোয়া যুবলীগ এবং নিজ গৃহে পালিত সাংস্কৃতিক কর্মীদের। আর জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আবরণ হিসেবে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু আবেগাক্রান্ত তরুণকে। কারণ তাদের বয়সটাই এ রকম যে যুক্তির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে হৃদয়। এই হৃদয়কে বুদ্ধিমান যে কারও পক্ষে আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে নেয়া সম্ভব। এই আবেগের স্রোতে বাংলাদেশের তরুণদের ব্যবহার করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সস্তা বুলিসর্বস্ব স্লোগান তুলে বাংলাদেশের তরুণদের ঠেলে দিয়েছিল শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনীসহ নানা ঘাতকদের মুখে। গঠন করেছিল গণবাহিনী। হাজার হাজার তরুণ সে সময় একটি আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে ভুল নেতৃত্বের চোরাবালিতে আটকে অকাতরে প্রাণ হারায়। সেসব নিহত তরুণের রক্তের ওপর পা দিয়ে, তাদের আত্মাহুতির সঙ্গে বেঈমানি করে ইনু সাহেবরা এখন মজাছে মন্ত্রিত্ব করছেন। সেজন্যই তাদের কাছে আমার আবেদন, সস্তা চটকদারি কথায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। দেশের ভেতরকার বিভাজন রেখাকে উত্পাটন করে সমন্বয়ের পথে তাদের এগোতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যারা বেশি বেশি বলে বেড়ায় তাদের সন্দেহ করতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, শহীদ মুনির চৌধুরী, কবির চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিমের মতো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরাও কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আজকের শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুনরাও কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেননি। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে বিভেদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হননি। যারা এই চেতনাকে হরদম দলীয় সম্পত্তি বানিয়ে ফেরি করে ফেরে, তাদের সত্যিকার মতলব চিনতে হবে। যদি এই শক্তির স্বরূপ উদঘাটন করতে আমাদের তরুণরা ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা থাকবে না। বাংলাদেশ পরিণত হবে আরেকটি হায়দারাবাদ কিংবা সিকিমে। আরেকটি বাকশালী ফ্যাসিবাদে জর্জরিত হবে দেশ। এই বাকশালের পদধ্বনি শাসকদল তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে দেশময়। নইলে যুদ্ধাপরাধীদের নাম করে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেসব ভয়াবহ উচ্চারণ করানো হয়েছে তা দেশে ডেকে আনবে নৈরাজ্য, বিপর্যয় ও গৃহযুদ্ধ। জামায়াত-শিবির দমনের ছদ্মবেশে তারা আসলে চাচ্ছে দেশপ্রেমিক শক্তির সমূলে উত্পাটন।

দুই.

গিরিশ কনরাডের ‘তুঘলক’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র যদি হন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাহলে বলতে হবে তার চাহিদা মোতাবেক রচিত নাটকের এখন চতুর্থ অংকের অভিনয় হচ্ছে। সর্বত্র এই অভিনয়ের প্রযোজক, পরিচালক, কুশীলব সবকিছুর জোগানদাতা তার সরকার ও শাসক দল। বাদবাকিরা হয়তো তার অদৃশ্য ইশারার ‘বড়ে’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চতুর্থ অংকের চূড়ান্ত দৃশ্য এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি শাহবাগে।
যারা এর মূল আয়োজক ছিলেন, যারা কাজটি শুরু করেছিলেন এরা এখন পার্শ্বচরিত্র। তারা সূচনা করে দিয়ে মাইক্রোফোন ও মঞ্চ তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি ছক অনুযায়ী শাহবাগ স্কোয়ারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন সরকার অনুগতদের দখলে। আমাদের মহামহিম সরকার এখানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার কাজটা করেছে।
এই পাখি মারার কৌশল হিসেবেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের জন্ম দিয়েছিল। তারপর জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হলো। সমস্যা দেখা দিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যে ১৯৫ জনকে স্বয়ং শেখ মুজিব চিহ্নিত করেছিলেন তারা তো আওয়ামী লীগকে ‘টা টা’ দেখিয়ে কবেই পগারপার হয়ে গেছে। সে তালিকায় তো বর্তমান অভিযুক্তদের নাম ছিল না। তো কী করা। এবার ট্রাইব্যুনালকে কিঞ্চিত্ প্রলেপ মাখিয়ে বলা হলো একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবে তারা। তারপর অনুগ্রহভাজন লোকদের এনে বানানো হলো কাঠামো। দলীয় উকিল-মোকতারদের নিয়োগ দিয়ে দাবি করা হলো ‘আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। সাক্ষী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে চললো কৃত্রিম প্রমাণ উপস্থাপনের মচ্ছব। অর্থাত্ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। যদি তা না হতো, তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের নাম দিয়ে দলীয় আইনজীবী, দলীয় তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশীয় বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হতো না। ট্রাইব্যুনালের ‘পদত্যাগী’ চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে নিয়ে তো শুরুতেই বিতর্ক দানা বাঁধে। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনিই একবার এর বিচার করেছেন। এ ধরনের বিতর্কিত লোক দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকারই সৃষ্টি করে চরম বিতর্ক। এখানে আন্তর্জাতিক শব্দটি ছাড়া আর কিছুই আন্তর্জাতিক মানের নেই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন :
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাধা প্রদানকারীরাও সমান অপরাধী’—এই বক্তব্যকে সমর্থন করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে যে আইনে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের বিচার হচ্ছে, এই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তান আর্মির ৪৫ হাজার সেনাসদস্যের ভেতর থেকে গুরুতর অপরাধী হিসেবে ওই ১৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শেখ মুজিবেরও মরণোত্তর বিচার দাবি করতে পারে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে নিয়ে শাসক দল দেশজুড়ে যে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে, সে সম্পর্কেও খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
আমি ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ছিলাম। ওই সময় দালাল আইনে বিচারের জন্য পাকিস্তান আর্মির এদেশীয় ২৮ হাজার সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের আটক করা হয়েছে, ওই ২৮ হাজার বন্দীর মধ্যে এরা কেউ ছিলেন না। এরা যদি এতই ভয়ঙ্কর অপরাধী হতেন, তাহলে এদের একজনকেও ওই সময় গ্রেফতার তো দূরের কথা, এদের কারও বিরুদ্ধে দেশের কোনো একটি থানায় একটি জিডিও করা হলো না কেন? তিনি বলেন, যে কাদের মোল্লাকে এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তিনিই স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি যদি ‘কসাই কাদের কিংবা জল্লাদ কাদের’ হন, তাহলে আজ যারা তার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা কেন তাকে ওই সময় আটক করে পুলিশে দিলেন না? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আজ সাধারণ জনগণের মাঝে। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দালাল আইনে আটক করা হয়েছে। এখন তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই সময় তার বাবার সঙ্গে তাকেও কেন গ্রেফতার করা হলো না কিংবা তার নামে একটি মামলা বা জিডি করা হলো না? মূলত সরকারের কিছু লোক তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নেই। মানুষ চায় এখন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হোক।

তিন.

সারা পৃথিবী বললো এই আদালত গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিধি মোতাবেক হয়ইনি। কিন্তু সরকারপ্রধান থেকে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী কর্মীরা পর্যন্ত বললেন, এরকম অনন্যসাধারণ আদালত এদেশে আর হয়নি। এটা পুরোপুরি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ।
এর মধ্যে বোমা ফাটালো দ্য ইকনোমিস্ট। বিস্ফোরণ ঘটালো দৈনিক আমার দেশ। স্কাইপ কথোপকথনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো এর অন্তঃসারশূন্যতা। প্রমাণিত হলো এ কোনো আদালত নয়—এটা হলো কিছু মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য আইনি লেবেল লাগানোর একটা পদ্ধতি।
বাধ্য হয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করে একে আরও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণিত করে দিলেন। তারপরও সরকারের মন্ত্রীরা গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে বলে বেড়াতে লাগলেন, এই আদালত সুন্দর, এই আদালত স্বচ্ছ। আর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব ক’জন অভিযুক্তকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
আশ্চর্য, বিচারের আগেই মন্ত্রীরা রায় ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন। রায় বেরুলো মওলানা আবুল কালাম আজাদের ফাঁসি। মহাখুশি আওয়ামী মহল। ধন্য ধন্য করে উঠলো আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রাঙ্গণ। তাদের জোটের ছাগল-পাগলগুলোও তিড়িং বিড়িং করে বাড়ি মাথায় তুললো।
এই আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেই রায় বের হলো আবদুল কাদের মোল্লার। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল তাদেরই আদালত। এবার উল্টো প্রতিক্রিয়া। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, পাতি নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত সবাই চিত্কার শুরু করে দিলেন এই রায় মানি না। এই বিচার মানি না। জামায়াত তো আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারাও এই রায় মানে না।
জামায়াতের আস্থা, আন্তর্জাতিক বিশ্বের আস্থা তো আগে থেকেই ছিল না। এবার সরকার এবং তাদের অনুগ্রহপ্রাপ্তদের আস্থাও গোল্লায় গেল। দেখা যাচ্ছে এই আদালতের ওপর কারও কোনো ভরসা নেই, আস্থা নেই, গ্রহণযোগ্যতাও নেই।
আওয়ামী লীগের লেগেছে ইজ্জতে। নাকি এটাও নতুন কোনো চাল? কে জানে? তারা আদালতকে বাধ্য করার জন্য ছাড়তে লাগলো হুঙ্কার। পাশাপাশি গগণবিদারী স্লোগান। অনুগত দু’একটি বাম দল এই হুঙ্কারে উদ্বেলিত হয়ে জায়গা নিল শাহবাগ মোড়ে। তাদের গান-বাজনা, বক্তৃতা-বিবৃতির পথ ধরে মাঠে নামলো ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর কিছু তরুণ যারা নিজেদের ব্লগার পরিচয় দিতে পছন্দ করে। আসলে এরাও আওয়ামী লীগের অন্য ধরনের ক্যাডার। তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে—আদালতকে বাধ্য করার জন্য জড়ো হলো। শাহবাগ স্কোয়ার ভরে উঠলো জনসমাগমে। বুঝতে বাকি রইলো না, যারা জড়ো হলেন তাদের ৯৫ ভাগই আওয়ামী লীগের লোকজন। সবার একটাই ‘স্বপ্ন’—শাহবাগ স্কোয়ারকে ‘তাহরির স্কোয়ার’ বানাবেন। এই জনসমাগমকে জনসমুদ্র বানানোর কাজটিও অবশ্য সরকারই করে দিয়েছে।
শাহবাগ স্কোয়ারের আওয়াজকে আরও বুলন্দ করে দেশময়, বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কৃতজ্ঞতাভাজন মিডিয়া উঠলো কলকাকলীমুখর হয়ে।
তাহরির স্কোয়ারে মহাসমাবেশ হয়েছিল স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে। জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের শাহবাগের দাবিতে সেসব কিছু নেই। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড, গুম, ধর্ষণ, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, টিপাইমুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিধ্বস্ত বিচার ব্যবস্থা, মরণোন্মুখ শিক্ষাঙ্গন এখানকার এজেন্ডায় ঠাঁই পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়।
শাহবাগের এক দফা এক দাবি। ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত বিচারাধীন সবাইকে ফাঁসি দিতে হবে। তাদের বক্তব্যে, আদালত মানি, বিচারও মানি। কিন্তু রায় হতে হবে আমাদের দাবি মোতাবেক। যে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে, তাকেও রায় বাতিল করে ফাঁসি দিতে হবে। অর্থাত্ এক ধরনের জুডিশিয়াল কিলিং শুরু করতে হবে। এই প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন : আইন ও আদালতকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সংগ্রাম করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে। সরকারি দল এখন তার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করছে। ওই বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় নেতারা এমনকি মন্ত্রীরাও গিয়ে ফাঁসির দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে আরও মামলার রায় অপেক্ষমাণ। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে একটি মেসেজ যাচ্ছে। সামনে যদি কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক হবে যে, বিচারকরা সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ভয়ে এই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বিচারকদের ঘাড়ে ক’টি মাথা যে তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় দেবেন? কাজেই আমি বলব, ফাঁসির দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন এমনকি ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতেও যারা আন্দোলন করছেন, তারা ঠিক কাজটি করছেন না। এতে করে দেশ ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যেই আদালত গঠন করুক না কেন, বিচারকরা ‘নিউট্রাল’ বিচার করবেন—এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। আদালত রায় দিয়েছেন। সংসদে সরকারি দলের এমপিরাও এ নিয়ে কথা বলছেন। এটা বড়ই দুঃখজনক। তিনি বলেন, আদালত বা রায় নিয়ে হরতাল ও অবরোধ করা উচিত হচ্ছে না। হরতাল বা অবরোধ করে ফাঁসি দেয়া যাবে না। এতে দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিচারকরা সব সময় ভয়ে থাকবেন। এসব করে যদি আদালতের কাছ থেকে ফাঁসি আদায় করা হয়, সেটা হবে দুঃখজনক। ব্যারিস্টার হক বলেন, রায়ের পর পুলিশ প্রটেকশনে বিক্ষোভ হচ্ছে। মন্ত্রীরা সেখানে গিয়ে বলেছেন—এ রায় মানি না। তাহলে বিচারকরা কী করে তাদের রায় দেবেন? যেভাবে ফাঁসির দাবি উঠেছে, বিচারকদের তো ফাঁসি না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে যে রায় দেবেন তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফাঁসির আদেশ না দিলে, যে বিচারক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি তার কী অবস্থা হবে! তার ফ্যামিলির কী অবস্থা! কে তাদের প্রটেকশন দেবে?
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশকে একটা আইডিয়াল সিচুয়েশনে আসতে হবে। অ্যাবনরমাল সিচুয়েশনে থাকবে তা কিন্তু কেউ চায় না।
দেশ যখন আদালত ও তাদের রায় নিয়ে সরকারের কাণ্ড-কারখানা দেখে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় অধীর, আদালত যখন পরিষ্কার হুমকি ও ধমকের মুখে, সেই সময় শাহবাগ চত্বরের উদ্যোক্তাদের একজন আরিফ জেবতিক্ বলেছেন, ‘আমরা চাই ট্রাইব্যুনাল মাথা উঁচু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করুন।’ আস্থাহীন, গ্রহণযোগ্যতাহীন, স্বচ্ছতাহীন একটি আদালত রীতিমত ভীতির মুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে মাথা উঁচু করে রায় দেবে আল্লাহ মালুম।
আবার মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, আইন ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা যার প্রধান কাজ— তিনি বলেছেন, সব সময় আইনই বড় কথা নয়। মানুষ কী চায় সেটাই বড়। এসব কথা বা বক্তব্য যে তাদের মূল এজেন্ডা নয় তা বোঝা গেল গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার থেকে। ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির মুণ্ডুপাত করা থেকে। একই সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্মূল করার জন্য আড়াই হাত লাঠি ব্যবহারের নির্দেশ থেকে। বোঝাই যাচ্ছে দেশ ধ্বংস করে, দেশের মানুষকে হত্যা করে হলেও এই অপশক্তি আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে মসনদ। মনে হচ্ছে এজন্য বাইরের হস্তক্ষেপ চাইতেও তারা ইতস্তত করবে না।

চার.

আমি আগেই বলেছি, এখনও বলি, শাহবাগ চত্বরে যে তরুণরা জড়ো হয়েছে তাদের আমি ছোট করে দেখতে চাই না। মমতা দিয়েই দেখতে চাই। কারণ তারা আমারই মতো কোনো না কোনো পিতার আদরের সন্তান। কিন্তু তাদের আচরণ-উচ্চারণ আমাকে স্তম্ভিত করেছে। তাদের জন্য আমার একটাই কথা, আমাদের রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে পচিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের শাসকদের ভূমিকা অগ্রণী। তারা তোমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে, দেশের সব সমস্যা ও সঙ্কট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, নিজেদের কৃত পাপকে ধামাচাপা দিয়ে, জনগণকে বোকা বানিয়ে আবারও ক্ষমতায় থাকার ষড়যন্ত্র করছে। তোমাদের আবেগের সমুদ্রে ভাসিয়ে গোছাতে চাচ্ছে নিজেদের আখের। সেজন্য তোমাদের সতর্ক থাকাটা জরুরি। সরকারি লোকজনের দেশের বাইরে বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু তোমাদের আছে শুধু এই দেশটি। এই বাংলাদেশ। সেই একমাত্র থাকার জায়গাটি যাতে নষ্ট না হয়, যাতে এর অস্তিত্ব বিলীন না হয় সেজন্য তোমাদেরকেই তো লড়তে হবে। দেশ রক্ষার সেই লড়াইয়ের ময়দান থেকে কেউ যাতে তোমাদের সরাতে না পারে সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। বিভেদ আর হানাহানির ভেদবুদ্ধি নিয়ে নানা রঙে, নানা পোশাকে অনেকেই আজ তত্পর। সেই তত্পরতা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান তোমাদের থাকতে হবে। যদি তা অনুধাবনে ব্যর্থ হও তাহলে ইতিহাস তোমাদেরও ক্ষমা করবে না।
তরুণদের জাগরণ চাই, সমস্ত অন্তর দিয়ে চাই। কারণ তারাই পলাশীর মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা রক্ষার। তাদেরই পূর্বসূরি তিতুমীর সামান্য বাঁশের কেল্লা বানিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সবই সংঘটিত হয়েছিল তরুণদের জন্য। তরুণরা না জাগলে দেশ জাগে না। এখন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের কর্তব্য হবে তারুণ্যকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। তারা কেন বিশেষ দলের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হবে?

পাঁচ.

শাহবাগে সরকার প্রযোজিত, পরিচালিত ও অভিনীত যা কিছু হচ্ছে তার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছি। তারপরও দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের উদ্দেশ্যে বলতে চাই—কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকবেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ কখনও যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে না। পারে না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও পাবেন না। পারবেন না এই সরকারকে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে বিতাড়িত করতে।
শাহবাগের চতুর্থ অংকের ফসল শেখ হাসিনা ঘরে তুলতে পারবেন কি-না জানি না। তবে পঞ্চম অংকের দৃশ্যগুলো যে দেশকে টালমাটাল করে দেবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সেই দুঃসময় যদি আসে, তাহলে দেশপ্রেমিকরা যেন সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতির মধ্য দিয়ে দেশ রক্ষার কাজটি ঠিকমত সম্পাদন করতে পারেন সেই আশায় ব্যাকুল হয়ে রইলাম।
a_hyesekder@yahoo.com

রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১২

যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এখন থেকে একশ’ বছর পরে, অথবা এক হাজার বছর পরে, কিংবা আরও পরে, যদি তখনও মানুষ থাকে পৃথিবীতে, কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে আমাদের সময় ও জীবন নিয়ে—ন্যায়, নীতি, সততা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, বিচার ও প্রেমহীন একটি সময়ে ওই লোকগুলো বেঁচে ছিল কীভাবে? তাদের উদ্দেশে এই হানাহানি, বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসম্প্রীতি ও অবিবেচনায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সময়ের পত্রহীন, পুষ্পহীন, বাষ্পহীন, অনুতাপহীন প্রান্তর থেকে বলে রাখছি, যদি এই লেখা তাদের কাছে পৌঁছে আমাদের অনেক কিছু ছিল না, এ কথা সত্য। বন্য শুয়োরের কাদা ঘাঁটার মতো সীমিত, সংকীর্ণ ও নোংরা হয়ে পড়েছিল আমাদের জীবন। তারপরও আমরা বেঁচেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, আনন্দ ও বেদনার নুনপানিতে ভেসেছিলাম শুধু একটি কারণে—আমাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন। কবি আল মাহমুদ ছিলেন। মাত্র একজন কবি ছিলেন বলেই আমাদের প্রতিদিনের রুমালগুলো সূচিকর্মহীন ছিল না।
আজকের এই দিনে, এখনও যাদের মানুষ হিসাবে ধরে নেয়া যায়, এখনও যারা সাদা আর কালোর পার্থক্য কিছুটা হলেও ধরতে পারেন, তাদের বলি, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই আমরা আছি। যে কয়টি সংবাদ আমাদের প্রতিটি সূর্যোদয়কে সম্ভাবনাময় করে তোলে তার অন্যতম আল মাহমুদের বিচরণশীলতা। তাঁর সচলতা ও সক্ষমতা। তার বহমান সৃষ্টিশীলতা। তিনি আছেন বলেই আমাদের দিনগুলো কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে যায় না। ডুবতে ডুবতেও ডুবে যায় না, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শিশুর গালে চুমু খায়। আর রাতগুলো কালো হতে হতেও পুরো কালো হয় না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস তার নীরবতাকে চুরমার করলেও সে কিছুটা উদ্বেগহীনতার মধ্যে আরাম খোঁজে। তারপর স্বপ্ন দেখে ডাবের মতো চাঁদ, ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
দুই
বাংলা সাহিত্যে মীরদের প্রথম আবির্ভাব ১৮৪৭ সালে মীর মশাররফ হোসেনের মধ্য দিয়ে। প্রথম এবং অসাধারণ ছিলেন সেই মীর। ১৮৮৫-তে যদি তার বহু বিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ নাও প্রকাশিত হতো তাহলেও তাকে নিয়ে আজ আমরা যা বলছি, তার ব্যত্যয় ঘটত না। যে কোনো বিচারেই তিনি আমাদের নবজাগরণের অগ্রদূত। এই মীরের জন্মের ৮৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে দেশের আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় মীরের জন্ম। এই মীর আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ।
প্রথম মীরের সঙ্গে দ্বিতীয় মীরের মিল ও অমিল অনেক। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের পর আর যদি কিছু নাও লিখতেন, তাহলেও আল মাহমুদ আল মাহমুদই থাকতেন।
দুই মীরের বাড়ি দুই নদীর তীরে। একজন গড়াই কূলের। অন্যজন তিতাস তীরের। একজনের বিষাদ সিন্ধু এবং অন্যের সোনালী কাবিন—সমান মাত্রা ও শব্দবন্ধের। ‘স’ ও ‘ব’ তাদের মধ্যে সাধারণ। তবে অমিলটা হলো একজন মীর লিখতেন নামের আগে, অন্যজন মীর উপাধি কখনোই ব্যবহার করেননি।
কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য এই দুই মীরকে নিয়ে তার বিখ্যাত ‘মীর পরিবার’ গল্প গ্রন্থ লেখেননি। তবুও আহমদ মীর, মোস্তফা মীর, আশরাফ মীর এঁরা ‘মীর’ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন।
তিন
আসলেই ‘মীর’ বর্জনকারী আল মাহমুদ আমাদের জসীমউদ্দীন। আমাদের নকশিকাঁথার মাঠ। আমাদের সোজন বাদিয়ার ঘাট। আমাদের বালুচর।
তিনি আমাদের জীবননানন্দ। আমাদের মহা পৃথিবী। আমাদের সাতটি তারার তিমির।
তিনি নজরুলের সকালবেলার পাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাত সঙ্গীত।
তিনি আছেন আমাদের জাগরণে। আমাদের স্বপ্নে। আমাদের মনে। আমাদের দেহে। আমাদের তিনশত চল্লিশ নদীর বাঁকে বাঁকে। তিনি আছেন আমাদের পানিউড়ি পাখির ছতরে। তিনি আছেন ওপাড়ার সুন্দরী রোজেনার সর্ব অঙ্গের ঢেউয়ে। মকতবের মেয়ে আয়শা আখতারের খোলা চুলে। তিনি আছেন আমাদের ইসবগুলের দানার মতো জলভরা চোখে। আছেন শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশের চিকচিকে বালুতে।
আল মাহমুদ আছেন আমাদের সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে। পাহাড়পুরে। তিতাসে। ড্রেজার বালেশ্বরে। আছেন মুক্তিযুদ্ধে। আছেন বিরামপুরে। আছেন আমাদের খড়ের গম্বুজে। আমাদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। স্বপ্নের সানু দেশে। আল মাহমুদ আছেন আমাদের ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে। তিনি আছেন নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটিতে। তিনি আছেন ‘ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান’-এ। আছেন আমাদের চিন্তায়। চেতনায়। আমাদের সৃষ্টিশীলতায়।
চার
আল মাহমুদ আছেন বলেই এখনও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আল মাহমুদ আছেন বলেই আমরা এখনও হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি। আল মাহমুদ আছেন বলেই ড. ইউনূস বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মৌলিক মৃত্তিকা হয়ে ওঠেন। উঁচুতে তুলে ধরেন দেশের সম্মান ও মর্যাদা। আল মাহমুদ আছেন বলেই মুসা ইব্রাহীম, এমএ মুহিত, নিশাত আর ওয়াসফিয়া এভারেস্টের ওপর পা রাখেন। আর সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার।
নোংরা, সংকীর্ণ, মূর্খ ও স্বার্থপর কিছু প্রাণীকে এখনও যে এদেশের মানুষ কবি বলে সম্মান করে, সে তো শুধু এই কারণে যে আল মাহমুদ এখনও বেঁচে আছেন।
পাঁচ
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যে কথাগুলো লিখলাম তা পড়ে অনেকের গা জ্বলে যাবে। শরীর চুলকাবে। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মতো যারা একটু বেশি শয়তান, তারা বলবে আবেগের দোকানদারি করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে।
তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি থাকবে। আমরা তাদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দেব। তারপর বলব, তোমাদের জীবন হলো নর্দমার ধারে। হাজারীবাগের ট্যানারির পচা পানিতে হয় তোমাদের অবগাহন। তোমাদের জীবন দুর্নীতি নিয়ে। তোমাদের সকাল হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। দিন কাটে দুর্নীতি করে করে। রাতে ঘুমাও দুর্নীতির বিছানায়। স্বপ্নও দেখো দুর্নীতি নিয়ে। সাহিত্য তোমাদের মতো ‘হারামখোর’দের বিষয় নয়। আর কবিতা, সে তোমাদের সইবে না। ‘সুসংবদ্ধ কথামালা’ নিয়ে স্বপ্নের সওদাগরি যারা করে, তাদের ভাষা বোঝার জন্য নতুন চরের মতো হৃিপণ্ড চাই।
স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই আমার চোখের চারদিকে তৈরি হচ্ছে ঘোর। এক ধরনের মায়াবী পর্দা উঠছে দুলে। কাজলের ছোঁয়ায় জেগে উঠছে প্রাণ। ভোরের মোরগের ডাক কানে আসছে। মোহনা কাছাকাছি বলেই বোধ করি শুনছি নোনা দরিয়ার ডাক। প্রিয় পাঠক, আসুন সেই সম্ভাবনা আর স্বপ্নের কথা তেলাওয়াত করি।
ছয়
জীবদ্দশায় আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কিনা আমি জানি না। মরণোত্তর নোবেল দেয়ার বিধানও চালু হয়নি। যা হোক, পেলে ভালো। না পেলে না পাবেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তো আর আল মাহমুদ কবিতা লেখেননি। এখন নোবেল পেলে আল মাহমুদের আর কী যায় আসবে। তবে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। না পেলেও বাংলাভাষীরা আল মাহমুদ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে তাদের ঘর ও অন্তর।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে তিনি বিশ্ব কবি সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাংলাদেশ ও এশিয়ার সীমা তো তিনি ছাড়িয়েছেন সেই ১৯৭৩-এ সোনালি কাবিনের যুগেই। এখন দরকার বাদবাকি বিশ্বের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আল মাহমুদ নেবেন কেন। নেব আপনি, আমি, আমরা।
তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের দেশে। নোবেল লরিয়েটের জীবনকে অতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের জুড়ি মেলা ভার। যেন নোবেল পাওয়াটা এক ধরনের ক্রিমিনাল অফেন্স। এই জন্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক জিল্লতি। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি পুরস্কারের অপমান করেছেন, এমন কথা বলার লোক সেদিনের কলকাতায় অভাব ছিল না। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গালাগাল করার ক্ষেত্রে আমাদের যদুমধুরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। অমর্ত্য সেন ও প্রফেসর সালামের মতো যারা একটু অপ্রভাবশালী শুধু তারাই কিছুটা রেহাই পেয়েছেন।
যা হোক, সম্ভাবনার শেষ নেই। সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। তাছাড়া সব ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হবে, এমন কোনো কথাও নেই। তো যদি আল মাহমুদ সৌভাগ্যক্রমে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান তাহলে কী হবে? এই কী হবের কোনো শেষ নেই। তার চেয়ে আমরা বরং ‘আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি-উত্তর প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে কিছু অগ্রিম বাক্যাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখি। এই সব কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া সত্য হোক, তা আমি চাই না। মিথ্যা হলে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব।
প্রতিক্রিয়া ১ : সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ সামাদ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, রবীন্দ্র গোপ, তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদ, মিনা ফারাহ, মাসুদা ভাট্টি, আসলাম সানি, লুত্ফর রহমান রিটনসহ আরও অনেকে নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখবেন—মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে থাকা একজন মৌলবাদী কবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে মূলত বাংলাদেশকেই অপমান করা হয়েছে। অবিলম্বে এই পুরস্কার প্রত্যাহার করা হোক।
প্রতিক্রিয়া ২ : কবি মোহন রায়হান, নাসির আহমদ বলবেন—নোবেল পুরস্কার পান আর যাই পান, তিনি স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল ছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ৩ : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলবেন—এর ফলে দেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পাবে। তাদেরই আশকারা দেয়া হলো। আমরা জানি কীভাবে নোবেল দেয়া হয়। আগে মদ খেতে হতো। এখন শরাব খেলেই পাওয়া যায়।
প্রতিক্রিয়া ৪ : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলবেন—নোবেল পুরস্কার পেলেই কেউ একজন কবি হয়ে যায় না। কবি হতে হলে রবীন্দ্রনাথের মতো ৮০ বছর বাঁচতে হয়। সংবিধানকে বুঝতে হয়।
প্রতিক্রিয়া ৫ : আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা আসবে তার কলামে—‘হাসান হাফিজুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, শামসুর রাহমান মরার আগে আমাকে বলে গেছেন, তাদের মৃত্যুর ২০ বছর পর যেন আমি বলি ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদের লেখা নয়। এটার একটা অংশ লিখেছিলেন শহীদ হুমায়ুন আজাদ এবং অন্য অংশ লিখেছিলেন আর একজন মরহুম এতাজ ইউসুফী।
প্রতিক্রিয়া ৬ : আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলবেন—নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঢুকে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়া ৭ : মতিয়া চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানাবেন—আল মাহমুদ তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা নির্মলেন্দু গুণের ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। সে আবার কিসের কবি।
প্রতিক্রিয়া ৮ : মাহবুব উল আলম হানিফের কথা—একজন মুক্তিযোদ্ধা যত বড় ত্যাগই স্বীকার করেন, তিনি যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাই হতে পারেন না, যদি না তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন। একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকই যেমন সঠিক মুক্তিযোদ্ধা, তেমন একজন কবি তখনই যথার্থ কবি এবং নোবেল পাওয়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন, যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন।
প্রতিক্রিয়া ৯ : সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলবেন—দেশে এত ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’র সৈনিক থাকতে কেন আল মাহমুদের মতো লোকেরা নোবেল পায়, তা উদ্বেগের বিষয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দিকটি আমার পুলিশ ও র্যাব খতিয়ে দেখছে।
প্রতিক্রিয়া ১০ : ড. সনজিদা খাতুন, শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুন বলবেন—তিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধ চাননি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ১১ : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং ড. আবুল বারাকাত বলবেন—আল মাহমুদের নোবেল প্রাপ্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোটেও বাড়বে না, বাড়বে না জিডিপি। তা হলে এ পুরস্কার ধুয়ে কি পানি খাব?
প্রতিক্রিয়া ১২ : ‘তিনি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাসাসের সভাপতি ছিলেন। সে সময় তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করেছিলেন কিনা তা দেখার জন্য মহামান্য আদালতের কাছে রুলনিশি জারির আবেদন করছি।’ এই আবেদনকারী হয়তো হবেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
প্রতিক্রিয়া ১৩ : ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, কিছু সাহিত্য সংঘের মাধ্যমে হয়তো গড়ে উঠবে একটি ‘আল মাহমুদের নোবেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সামনে টানা কয়েকদিন মানববন্ধন করবে। সেখানে বক্তারা বলবেন—দেশে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। ড. ইউনূসের পর এবার যারা কবি আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন তারা দেশদ্রোহী। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’-এর ভাড়াটে চর। এদের আক্কেলদাঁত উপড়ে ফেলা আজ জাতীয় কর্তব্য। দাঁত ওঠাতে সমস্যা থাকলে প্রত্যেকের একটি করে ঠ্যাং ভেঙে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।
প্রতিক্রিয়া ১৪ : মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলবেন—আই অ্যাম একদম ফেড আপ। অল আর রাবিশ। নোবেল কমিটি এখন দুষ্টু কমিটি, ওটা একটা ফটকা বাজার।
প্রতিক্রিয়া ১৫ : হাসানুল হক ইনু বলবেন—আল মাহমুদের সঙ্গে মৌলবাদী মানবতাবিরোধীদের সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাকে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলা সাহিত্য থেকে মাইনাস করতে হবে। তিনি যদি নিজে নিজে মাইনাস না হন, তাহলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে আমরাই তাকে মাইনাস করে দেব। কাউকে মাইনাস করার ক্ষেত্রে আমাদের যে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তার পুরোটাই এক্ষেত্রে প্রয়োগ করব আমরা।
প্রতিক্রিয়া ১৬ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হয়তো হাসতে হাসতে বলবেন—আল মাহমুদ নোবেল পেয়েছে তো কী হয়েছে? আগে পেয়েছিলেন একজন সুদখোর এবং এবার পেয়েছেন একজন ধর্মখোর।
প্রতিক্রিয়া ১৭ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলবেন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নোবেল পুরস্কার শোভা পাবে। আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার ভেতর দিয়ে সেই স্বপ্নই কিছুটা পূরণ হলো। এই নোবেল প্রাপ্তি দেশরত্ন বিশ্বনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারেরই একটি সাফল্য। আমরা এর আগে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বিজয় অর্জন করেছিলাম। তারপর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি সমুদ্রবিজয়ে। এই চ্যাম্পিয়ন লাভের ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রতিক্রিয়া ১৮ : কবি আল মাহমুদ যেসব বাড়িতে গেছেন, যাদের সঙ্গে মিশেছেন, তারা তড়িঘড়ি আল মাহমুদের সঙ্গে তোলা ছবি ড্রইং রুম ও অফিস কক্ষে বাঁধাই করে রাখবেন।
আর যেসব কবি-লেখক আল মাহমুদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন, তারা সেইসব সার্টিফিকেট ও ছবি নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় বিপুল বেগে নাজিল হবেন।
সাত
এই ডামাডোলের মধ্যে কষ্টে কঁকিয়ে উঠবে দেশের আত্মা। সাধারণ মানুষ আহত হবেন, হবেন ক্ষুব্ধ। যারা সত্যিকার অর্থে সাহিত্যনিষ্ঠ, যারা সাহিত্যকে সাহিত্য দিয়েই বিচার করেন, তারা হবেন হতবাক। হবেন মহা বিরক্ত। কেউ কেউ হয়তো স্মরণ করবেন জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর কথা। তারপর ভেবে কূল পাবেন না, আমাদের এরা কোন ফার্মের বাসিন্দা।
শুধু কবি আল মাহমুদ থাকবেন নির্বিকার। কণ্ঠে হয়তো বড় জোর বাজতে পারে নিজেরই কয়েকটি চরণ—
‘বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাত্ পাল্টে গেল। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃণ্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনাজুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার?’
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন : গৌরবের দিনলিপি : বই নয় আর্কাইভস



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক.
কথাশিল্পী আবু রুশদের একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ২২ জুন ১৯৯০-এ দৈনিক বাংলায় (দৈনিক বাংলা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যা করেছেন। সেজন্য বলতে হবে অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত সেই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আরেকটি জিনিস ঘটে, হয়তো একজন লেখক সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকটি উচ্ছ্বসিত ধরনের আলোচনা বা নিবন্ধ বের হয়ে গেল। অথচ সেই লেখক শক্তিশালী কেউ নয়। তাই—পাঠকরা এ ধরনের অতি উত্সাহী আলোচনা দেখে সেই লেখককে যখন যাচাই করতে যায়, দেখে বেশ ফাঁক রয়ে গেছে। তখন সামগ্রিকভাবে আমাদের লেখকদের সম্পর্কে নিরুত্সাহী হয়ে পড়ে তারা। হতাশ হয়ে যায়।’
এই অভিজ্ঞতাটা আমার ঝুলিতে আছে। অনেক অতি প্রগলভ, উচ্ছ্বাসের ফেনায় ভেসে যাওয়া গ্রন্থালোচনা পাঠ করে মূল বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়েছি। মনে হয়েছে গ্রন্থালোচক আমাকে প্রতারিত করেছেন।
দলবাজি, গ্রুপবাজি, অশিক্ষা ও অপুষ্টির শিকার আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ঘাড়ে চেপে বসেছে এক ধরনের প্যারাসাইট। এই পরান্নভোগীরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চায় চোখ। স্রেফ ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এদের বিচারবুদ্ধি হয় বিলুপ্ত। বড় হয়ে ওঠে উচ্চাভিলাষ। এজন্য কারণে-অকারণে নিজেদের এই নোংরা টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত লেখক যত জগামগাই হোক, কল্কি পেয়ে যান। যদুর চরকায় তেল দেয় জব্বার, জব্বারের চরকায় তেল দেয় মধু। মধু আবার যদুকে বড় করে তোলে। এই চক্রে এখন পচা পাগাড়ে আবদ্ধ শুয়োরের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য।
এই চক্র নিজেদের লেখক ও লেখকের বইকে নিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। আর তাদের হিসাবের বাইরের লেখক ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে থাকে নিঃশব্দ। এখন আবার এই প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে চটকদার বিজ্ঞাপন। নতুন আরেকটি ফ্যাশন এখন আমাদের সাহিত্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টাটাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বইয়ের মার্কিং করে এ বছরের সেরা ১০ বই, বছরের সেরা ৭ বই ইত্যাদি নামে। এসব ভাগ্যবান বই বা লেখক তাই বলে বাইরের কেউ নয়, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার খোঁয়াড়েই লালিত-পালিত বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন বাচাল লেখক।
কখনও কখনও বড় কিংবা আলোচিত হওয়ার জন্য লেখকদের মধ্যেও কাজ করে নানা ধান্ধাবাজি। এই ধান্ধাবাজির একদিকে থাকে চালাকি, শ্রমবিমুখতা ও তাস্কর্যবৃত্তি। অন্যদিকে থাকে ক্ষমতাসীনদের পা চেটে, তাদের স্তাবক বা নিশানবরদার সেজে ইহলৌকিক তরক্কি অর্জন।
এই জাতীয় লেখক দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছেন আমাদের দুই জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান। একই বই শত শত নামে বেরিয়েছে এ দুজনের জন্য।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক তোলপাড় করা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’র স্রষ্টা ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ‘কত ছবি কত গান’। সেই ইলিয়াস ভাই ’৭১-এর পরে মুজিব বন্দনার সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন ‘মুজিববাদ’ বই দিয়ে। ইলিয়াসের পাঠকরা এতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। আর বিরক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারা। কারণ তাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের বাড়া ভাত যেন কেউ কেড়ে দিতে চাচ্ছে। মুজিববাদের জন্যই ডুবলেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
ড. মাযহারুল ইসলামের বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পড়ে স্বয়ং শেখ মুজিব নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বইটির তথ্যগত ভ্রান্তি এবং বল্গাহারা বিশেষণ প্রয়োগের তাণ্ডব ধরিয়ে দিলে চুপসে যান গ্রন্থকার।
জিয়াউর রহমানকে নিয়েও একই কাণ্ড চলছে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের দ্বারা। এখানে আছে নানা সাইজ ও আয়তনের মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। বিভিন্ন লেখকের লেখা কালেকশন করে এক একজন এক একটা বই বের করেছেন। নিজের নাম ফাটানোর জন্য আছে নানা কায়দা। আবার এই একটি সংগ্রহ থেকেই লেখা নিয়ে আরও চল্লিশজন চল্লিশ নামে বের করেছেন বই। এর কোনো কোনোটির ওজন পাঁচ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নির্যাস নেই পাঁচ ফোঁটাও।
দুই.
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিরচিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনয়িন : গৌরবের দিনলিপি’। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন অ্যাডর্নেরই স্বত্বাধিকারী বন্ধুবর সৈয়দ জাকির হোসাইন। কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য এ ধরনের বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণ গড়পড়তা সাইজ নয়, রয়াল সাইজের এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৭৪। ওজন আনুমানিক ৩ কেজিরও বেশি। বৃদ্ধ এবং শিশুদের পক্ষে এ ধরনের বিশাল গ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, নাড়াচাড়া করাও দুঃসাধ্য।
যে কেউ এরকম জলহস্তির মতো বিরাট কলেবরের বই দেখে সত্যি সত্যি ভিরমি খেতে পারেন।
কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই যেহেতু ঘর পোড়া গরু, সেহেতু ভয় না পেয়ে উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করলাম। যাকে বলে আগাগোড়া স্কানিং করা, সে রকম পাঠ সমাপ্ত করতে মাসখানিক লাগার কথা। আমি বইটি ঘাঁটার (পড়ার জন্য নয়) জন্য সময় নিয়েছি মাত্র দুদিন। সে জন্য এ লেখাকে পাঠ-পরবর্তী নিবেদিত কোনো প্রবন্ধ হিসেবে না দেখে একটা দ্রুতরেখ মানচিত্র বলে ধরে নিলেই বাধিত হবো।
তিন.
ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘ইতিহাস এমনি একটি বিষয়, যা কখনও ঘটেনি এবং এমন লোকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, যে কখনও সেখানে ছিল না।’ প্রথমেই বলে নিই, এ বই সে রকম কোনো ইতিহাসবিদের রচনা নয়। এ বইয়ের লেখক মাহফুজউল্লাহ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক। কখনও তিনি নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা, কখনওবা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে আসা সচেতন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী, কখনওবা নেতা। সঙ্গত কারণেই ছাত্র ইউনিয়নের বিচারে তিনি ইতিহাস-মানুষ। ফলে অন্য দশটি তথাকথিত ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থকার ও গ্রন্থের ফারাক সুস্পষ্ট, দূরত্বও অনেকখানি। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য মানুষের মতো ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান’-এর মতো রুচিহীন কাজ এ গ্রন্থে কোথাও করেননি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনার স্তূপ তিনি খাড়া করেননি। অথচ এর সুযোগ ছিল। এই যে মাত্রাবোধ ও কাণ্ডজ্ঞান, সে জন্যই মাহফুজ উল্লাহ তার এই গ্রন্থের জন্য নন্দিত হবেন। পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখার জন্য এ বই যেমন পাবে পাঠকপ্রিয়তা, তেমনি অর্জন করবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা। এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ জোগাবে উপকরণ ও অনুপ্রেরণা। সে বিচারে এ বই জাতীয় ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি মাহফুজ উল্লাহর এই সময়োপযোগী প্রকাশনাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঠিক গ্রন্থ নয়, এ হলো একটা আর্কাইভস। একটি বিশাল আর্কাইভসের অক্ষরবন্দি রূপ। এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনুধাবনের নানা জিনিসপত্র। কেবল যেন পাঠের জন্য নয়, এ বই রচিত হয়েছে বিচরণের জন্য। উদ্যানের মধ্যে যেমন আমরা হেঁটে বেড়াই, এগাছ-ওগাছের কাছে যাই, এফুল-ওফুলের গন্ধ নেই, বর্ণ দেখে চমত্কৃত হই, কখনও হই বিচলিত—এ হলো সে রকম একটি আয়োজন।
আবার আমাদের ইতিহাসের অনেক হারিয়ে যাওয়া ভূভাগ, বিলুপ্ত অনেক অলিগলি, অনেক মানুষের অপরিসীম ত্যাগের কাহিনী পাঠক এর মধ্যে পাবেন। পাবেন একটি জাতির উত্থান এবং কিছু মানুষের পতনের বেদনাহত সূত্র। এজন্য এ বই আমাদের নিজেদের দেখার আয়নাও বটে। হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। এই পাঠে আমরা বিস্মিত হই, শিহরিত হই, ব্যথিত হই। কিন্তু আয়না থাকে নির্বিকার। এই নির্বিকারত্বই এ গ্রন্থকে মানোত্তীর্ণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি গ্রন্থ বিচারে বসি আমরা, তাহলে যে কেউ স্বীকার করবেন এই গ্রন্থ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশেরও ইতিহাস। এ গ্রন্থ শুধু ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি নয়, জাতীয় গৌরবেরও দিনলিপি।
চার.
বইয়ের শুরুতেই সবিনয় নিবেদনে লেখক বলেছেন, ‘আট বছরের পরিশ্রমের ফসল যে বইটি এখন হাতে নিয়েছেন তা প্রথাসিদ্ধ কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাস রচনার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের ভাণ্ডার।’ আসলেই এ গ্রন্থ একটা উপাত্তের ভাণ্ডার। ১২৭৪ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এ বই ধারণ করেছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৯ বছর।
ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই চারটি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সংগঠনটির জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাবান মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হন। এ ছাত্ররাই কর্মজীবনে দিয়েছেন প্রভূত সাফল্যের পরিচয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যে সময়সীমার কথা নিয়ে এ গ্রন্থ, সে সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ছাত্র ইউনিয়নই ছিল সবচেয়ে প্রাগ্রসর সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সদস্যদের দিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। করেছিল গভীরভাবে আত্মপ্রত্যয়ী। দিয়েছিল গৌরবময় জীবনের সন্ধান। যে গৌরবের সৌরভ আমাদের মতো অভাজনের গায়ে এখনও লেগে আছে।
মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ১৯টি পরিশিষ্টে সৃষ্টি হয়েছে এই বই। প্রতিটি অধ্যায় চিহ্নিত হয়েছে এক-একটি বছরের নামে। এই অধ্যায়গুলোর শুরুতেই আছে মূল বিষয়ের ওপর লেখকের কিঞ্চিত্ আলোকপাত। এরপর আছে ঘটনা প্রবাহ, যা গড়ে উঠেছে কেবল সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কাটিং নিয়ে। তারপর সংযুক্ত হয়েছে তথ্য নির্দেশ, যা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১৮টি অধ্যায়।
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর আলোকপাত, যা লেখকের নিজের লেখা, খুবই সংক্ষিপ্ত, একই সঙ্গে সংযমী ও পরিমিত। বাচালতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি মাহফুজ উল্লাহ।
পরিশিষ্টের ১৯টি অধ্যায় আসলে ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্টস, যা ইতিহাস গবেষকদের জন্য খুলে দেবে এক শস্যভারানত দিগন্ত।
আরও দিকের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আত্মবিশ্বাসহীন লেখককুলের অনেকেই বইয়ের ‘দাম’ বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট কেউকেটাদের দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে তার বাণিজ্যিক ব্যবহার। মাহফুজ উল্লাহ এই কদর্য কাজটি করেননি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই, এই ফাঁকে একটা ধন্যবাদ কি আপনাকে দেব?
আর একটা প্রশ্ন, বর্তমানকার অন্তঃসারশূন্য, দলবাজ ছাত্র সংগঠনগুলো এই বই থেকে কি কিছু শিক্ষা নেবে?
পাঁচ.
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন মাঝেমধ্যেই ভারি ভারি কিতাব প্রকাশ করে। সেগুলো কতটুকু খাদ্য আর অখাদ্য তা বলতে পারবো না। কিন্তু সেসব দেখে চোখ জুড়িয়েছে। বিশেষ করে আনোয়ার দিল অ্যান্ড আফিয়া দিল প্রণীত ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ সম্পাদিত ‘মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ : বাংলাভাষা স্মারক’-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ড. মাহবুব উল্লাহর গ্রন্থটি যখন বের হয় তার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে আমি অষ্টপ্রহর জড়িত। কিন্তু ভুলেও তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তিনি আমার মতো অনেক আমজনতার কাছে পুরো বিষয়টি চেপে রাখেন।
হয়তো তিনি আমাদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রকাশের পর ১০ কেজি ওজনের ঢাউস বইটি তিনি যখন আমার হাতে দেন, আমি আঁেক উঠি এবং হতবাক হই। আরও হতবাক হই, দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তার মোটামুটি জীবনপঞ্জি আছে বইটিতে। কিন্তু তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী—তার উল্লেখ নেই। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের হাতে এমনটা হয়েছে হয়তো তথ্য সংকটের কারণে। তো এই হতবাক দশা এখনও কাটেনি বলে মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের শত গালাগাল শুনেও বইটি নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা হয়ে ওঠেনি।
শেষ করার আগে মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ। কারণ তিনি জানেন ‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ সেজন্যই সেই নারী, তার গৃহের জিম্মাদার দিনারজাদী বেগমকে তিনি ভোলেননি। তার সবিনয় নিবেদন শেষ হয় তার নাতি-নাতনীদের জন্য আশাবাদে—‘আমার তিন নবীন প্রজন্ম আরমান রাকিন হক, দিয়ান জাকারিয়া ও জাহরান হাবীব যদি বড় হয়ে আমার যৌবনে লালিত বিশ্বাসকে ধারণ করে, তাহলে এই বই লেখা সার্থক হবে।’
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ যদি এই বই পাঠ করে উপকৃত হয়, উজ্জীবিত হয়, বাংলাদেশের দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে আসে—তাহলেই হলো।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

ভিলেন সিরাজদৌলা হিরো প্রণব মুখোপাধ্যায়


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

‘এলাম দেখলাম জয় করলাম’ বলে যে কথাটি বিখ্যাতদের বেলায় প্রচলিত, সে কথাটি আরও একবার সত্য হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’র বেলায়। এই নাটকটি প্রথমবার কলকাতার মঞ্চে আসে ১৯৩৮ সালের ২৯ জুন। অর্থাত্ পলাশী বিপর্যয়ের ১৮১তম বার্ষিকীর ৬ দিন পর এবং সিরাজের শাহাদাতবার্ষিকীর ৪ দিন আগে। মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকটি অর্জন করে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। পরবর্তীকালে মূলত এই নাটকের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’। শচীন বাবুর নাটক জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই নাটকটি আগাগোড়া সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন নজরুল। নাটকে ব্যবহৃত ৬টি গান, ‘আমি আলোর শিখা,’ ‘ম্যায় প্রেম নগরকো জাউঙ্গি’, ‘কেন প্রেম যমুনা আজি’, ‘পথ হারা পাখি’, ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’ ও ‘পলাশী হায় পলাশী’ নজরুলের লেখা। এই নাটকের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন নজরুল।
মঞ্চের পাশাপাশি ১৯৩৯ সালের ২৪ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে একটানা ২ ঘণ্টা এই নাটক প্রচারিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্র থেকে। সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী। আলেয়ার সংলাপ দিয়েছিলেন ঊষাবতী। গান গেয়েছিলেন হরিমতি। অবশ্য মঞ্চে কণ্ঠ দিতেন নীহারবালা। রেডিওতে এ নাটক পরিচালনা করেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।
এর পরপরই এইচএমভি কোম্পানি থেকে এই নাটকের রেকর্ড বের হয়। রেকর্ডে আলেয়ার গানে কণ্ঠ দেন পারুল বালা ঘোষ। ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন মৃণাল কান্তি ঘোষ।
নাটকের পাড়া অতিক্রম করে এই সিরাজদৌলা অচিরেই সগৌরবে জায়গা করে নেয় যাত্রা দলে। সেদিন থেকে অদ্যাবধি যাত্রার পালায় সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে পরিবেশিত হচ্ছে সিরাজদৌলা। জনপ্রিয়তার বিচারে অদ্যাবধি শচীন বাবুর সিরাজদৌলা একমেবাদ্বিতীয়তম। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি অন্য কোনো নাটক। ৭৪ বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী দর্শক গভীর আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখে যাচ্ছে সিরাজদৌলা। কারণ সিরাজদৌলা কেবল একটি নাটক নয়, সিরাজদৌলা তার জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির নাম। সিরাজদৌলা তার স্বাধীনতার প্রতীক। তার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই এই নামটির তুলনা হয় না।
দুই
এই সিরাজদৌলা নাটকে দেশ ও জাতির এক সঙ্কটকালে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজদ্দৌলা দীর্ঘ এবং বেদনাঘন, উদ্বেগ ও আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে দরবারে বলছেন, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আল্পনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রোরুদ্যমানা জননী নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে, কে শোনাবে জীবন দিয়েও রোধ করবো মরণের অভিযান।’ এই দীর্ঘ সংলাপটি দর্শকের মর্মমূলে আজও অবিরত ক্ষত সৃষ্টি করে যাচ্ছে। কারণ যাদের আশা দেয়ার কথা ছিল, ভরসা দেয়ার কথা ছিল—তারা সবাই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বিদেশি সাদা চামড়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল নিজেদের আত্মা। এজন্যই ‘হাজার হাজার সৈন্য পলাশীর প্রান্তরে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল আর পরাজয় পিছন থেকে এসে জাতির ললাটে কলঙ্কের কালিমা মাখিয়ে দিয়ে গেল।’
কী কুক্ষণেই যে শচীন সেনগুপ্ত এই সংলাপগুলো লিখেছিলেন, ভেবে আজও মাথায় হাত দিতে হয়। কারণ সেই যে ২৫৫ বছর আগে পলাশী যুদ্ধের দিনকয়েক আগে সিরাজদৌলার মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন, যে বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। সেই দুর্যোগ যেমন ১৯৩৮ সালে নাটক রচনার সময় ছিল, তেমনি ২০১২ সালেও বহাল তবিয়তে জাতির মাথার ওপর জমাট বেঁধে আছে। এতটাই জমাটবদ্ধ যে, সহসা যে তা মেঘমুক্ত হবে তার কোনো আশাই নেই।
রাজনীতিতে এখন শুধু ‘রাজ’। ‘নীতি’ উধাও হয়ে গেছে সেই কবে। অর্থনীতির অর্থ এবং নীতি দুটোই আজিমপুর আর বনানীতে সাড়ে তিন হাত কবরের নিচে চাপা পড়েছে। আদর্শ, মূল্যবোধ, মানবিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর আইনের শাসন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ফারাক্কা লাঞ্ছিত পদ্মার বুকে। যানজটে লটকে গেছে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দুর্নীতি, হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানি, সবার ওপর ঘৃণা, সংশয় আর সন্দেহ এখন পিশাচের মতো খুবলে খাচ্ছে আমাদের শ্যামল কোমল পাললিক মৃত্তিকা। আমাদের হৃিপণ্ড।
আধিপত্যবাদের দাঁত ঘষটানি দেখার জন্য এখন আর সীমান্তে যাওয়ার দরকার হয় না। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে তাদের অনুচররা বাসা বাঁধেনি। এখন দেশপ্রেমিকদের বানানো হচ্ছে ভিলেন, আর ভিলেন বীরের মুকুট মাথায় দিয়ে জেঁকে বসেছে সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবনের সর্বত্র। পলাশীর আগের মুর্শিদাবাদ আর আজকের ঢাকার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক অবশিষ্ট নেই।
এই দুর্বিষহ অবস্থা আরও বেশি বেশি ঘনীভূত হয় পলাশী দিবস এলে। তখন নতুন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের এদেশীয় দাললারা। তারা অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে কষে গালাগালি দিতে থাকে হতভাগ্য নবাব সিরাজদৌলাকে। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো, যা কিছু তার নিজস্ব, যা কিছু তার অর্জন—সেগুলোকে পদপিষ্ট করার পাশাপাশি আচ্ছা রকমভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য শুরু করে সিরাজদৌলা সম্পর্কে। ক্ষেত্রবিশেষে নিখাদ গালাগালিতে পর্যবসিত হয় এই বিবমিষা। যেন সিরাজদৌলার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করাই এই শ্রেণীর লেখক-বুদ্ধিজীবীর কাছে সর্বশেষ ফ্যাশন।
এই গালিবাজদের শরীরে যে রক্তস্রোত বয়ে যায় এবং কী কারণে এরা সিরাজবিদ্বেষী, তার নতিজা পেশের আগে আরও একটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রতি বছরই আমাদের এই শ্রেণীর জনমণ্ডলী বিশেষ একটি বিষয় নিয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে। তাল, লয়, মাত্রা জ্ঞান হারিয়ে স্তাবকতা, প্রশংসা ও বিশেষণ প্রয়োগের জন্য পাগল হয়ে যায়। এক ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন মাতলামি আর কী?
তিন
এবার আমাদের বঙ্গপুঙ্গররা অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। বলা যায়, প্রণব বন্দনার মচ্ছব চলছে এখন বাংলাদেশে। বিগলিত লেখক, রাজনীতিবিদ, কলামিস্টরা লিখছেন—বাঙালির হাজার বছরের সৌভাগ্য যে একজন বাঙালি প্রথমবারের মতো ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত। আমরা ধন্য। প্রণব মুখোপাধ্যায় মহান। তিনি মহামহিম। তিনি এশিয়ার শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। অনেকে তাকে এশিয়ায়ও আটকে রাখতে নারাজ। তারা বলছেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। তিনি শ্রদ্ধেয়। তিনি পণ্ডিত। তিনি বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রনেতা। তিনি নম্র। তিনি বিনয়ী। তার জ্ঞানের তুলনা কেবল অগণন নক্ষত্রখচিত আকাশ।
বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের মহান বন্ধু। তিনি অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের আপনার চেয়ে আপন মানুষ তিনি। বাংলাদেশের জন্য তার ভালোবাসা বঙ্গোপসাগরের পানির চেয়েও বেশি। যদি তার জন্ম না হতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না।
এই বেআক্কেল মূর্খদের কে বোঝাবে যে, পদ্মা নদীকে হত্যা করার জন্য যে ক’জন মানুষ দায়ী, তিনি তাদের একজন। যে টিপাইমুখ নিয়ে উত্কণ্ঠায় অধীর আজ বাংলাদেশ, তিনি তার অন্যতম উদ্যোক্তা। ভারতের রক্তপিপাসু বিএসএফের হাতে প্রতিদিন যে বাংলাদেশের মানুষ খুন হয়, সেজন্য তিনি একবারের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেননি। বিএসএফের বিচার তো দূরের কথা।
তিনি সিডরবিধ্বস্ত উপকূলীয় বাংলাদেশের একটি গ্রাম নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিলেন, দেননি। তিনি তাদের মোসাহেব ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের সময় ৫ লাখখ টন চাল দিতে চেয়ে একটা কণাও দেননি। উপযুক্ত মূল্য দিতে চাওয়ার পরও দেননি। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার জন্য সামান্যতম সহানুভূতিও তার কাছ থেকে বাংলাদেশ পায়নি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সত্য। সেজন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে দাঁড়ানোটাও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে। এডওয়ার্ড কেনেডি, তাকাশি হাওয়াকাওয়া, জন স্টন হাউজ কিংবা অদ্রে মালরোর মতো একক ব্যক্তি হিসেবে নয়। তার দাঁড়ানোটা ছিল ভারতের কৌশলগত সিদ্ধান্তের ফসল।
আরও একটি জিনিস দেখবার। আমাদের দাস্য মানসিকতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এক চক্ষু অন্ধ ব্যক্তির মতো আচরণ করে। তাদের যদি দুই চোখই খোলা থাকতো তাহলে দেখতে পেত, ভারতের যে রাজ্যের তিনি বাসিন্দা সেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্তু তাকে নিয়ে মোটেই আমাদের দেশের লোকজনদের মতো লাফালাফি-ফালাফালি করছে না। তারা মোটেই মাত্রাজ্ঞান হারায়নি। বিশেষণ প্রয়োগের বন্যাও সেখানে হয়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরিষ্কার বিরোধিতা করছেন প্রণব বাবুর। তার বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলছেন, নামেই তিনি বাঙালি এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই করেননি।
যাদের মানুষ প্রণব বাবু তারা তার ব্যাপারে উদাসীন এবং বিরোধী। আর আমরা যারা বাইরের লোক, তাদের ঢাকের শব্দে কান ঝালাপালা। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই।
অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন একবার। আমাদের গবেটগুলোকে মানুষ বানানোর দায়িত্ব কে নেবে? দায়িত্ব নিলেও হয়তো এরা সুস্থ হবে না। কারণ এর আত্মা এদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তা বন্ধক পড়ে গেছে অন্যত্র। এখন হাজার চাইলেও এদের আর ফেরার উপায় নেই।
চার
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভ আর আমাদের মীরজাফর সাহেব মিলে পলাশীর মাঠে যুদ্ধ নামের প্রহসন করে কেড়ে নিয়েছিল বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা। এই প্রহসনের আড়ালে ছিল নিম্নশ্রেণীর নিকৃষ্ট কুিসত ও জঘন্য প্রকৃতির ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা। এই ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সিরাজদৌলা।
এখন নিজেদের এই বেঈমানি আর জটিল-কুটিল জালিয়াতি-ষড়যন্ত্রকে যদি আড়াল করা না যায় তাহলে পলাশীর যুদ্ধকে জায়েজ করা যায় না। এজন্যই নিজেদের যদি হিরো সাজতে হয় তাহলে সিরাজকে ভিলেন বানানো ছাড়া অন্য পথ তো নেই। সিরাজকে যত নিচু ও নোংরা করে দেখানো যাবে, ততই উজ্জ্বল হবে তাদের নাম। এজন্যই সিরাজদৌলার চরিত্র হননের কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অব্যাহতভাবে চালিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার। এই কাজে তারা লাগিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ভারত প্রবাসী সাদা চামড়ার সায়েব লেখকদের। আর সবচেয়ে বেশি সাহায্য তারা পেয়েছিল তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রডাক্ট কলকাতাকেন্দ্রিক অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি ও পদোন্নতি-ভিখারী বাবু-বুদ্ধিজীবীদের। জাতীয় ইতিহাসের কলংক তথাকথিত জমিদার শ্রেণীর। তারও আগে মীরজাফরের সময় থেকে কিছু বেতনভুক্ত ইতিহাস লিখিয়েদের দ্বারা কোম্পানি নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে উত্পাদন করিয়েছিল ইতিহাস। পাশাপাশি পথে-প্রান্তরে সিরাজদৌলাকে হেয় করার জন্য, তার ভাবমূর্তি বিনাশ করার জন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল ভাড়াটে লোকজন। গুজব ও গল্প ইতিহাসের নামে তাই চলে আসছিল তখন, এমনকি এখনও।
খুব সঙ্গত কারণেই বিজয়ী পক্ষ পরাজিতের স্কন্ধকে নিজেদের পাপ স্থাপনের সুউচ্চ মঞ্চ বানিয়েছে। ফলে সত্য হয়েছে মিথ্যা, মিথ্যা পেয়েছে সত্যের সম্মান। আর এই মিথ্যাচার, লোককথা, গল্পকে বাছ-বিচার না করেই ইতিহাসের নামে, গল্পে, কবিতায়, মহাকাব্যে দেদার পরিবেশন করেছে বাংলাভাষী মরুদণ্ডহীন কবি ও গদ্যকাররা।
উপনিবেশবাদের পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করে সেদিন নাম ও অর্থ কামিয়েছিল রাম রাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কিংবা কবি নবীন চন্দ্র সেনরা।
মাত্র একজন মানুষ এই অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেই ১৮৯৮ সালে। তিনি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়। তার ‘সিরাজদৌলা’ গ্রন্থ দিয়ে উদঘাটন করেছিলেন আসল ইতিহাস।
কিন্তু তার হাজার কোশেশ সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক ও সাম্রাজ্যবাদের আদর-আহ্লাদে যারা বড় হয়েছিলেন তাদের ছাও-আণ্ডা, বাল-বাচ্চারা আজও সমান তালে সিরাজদৌলার চরিত্রে কালি মাখিয়েই যাচ্ছেন।
সম্প্রতি এই পাপ ও পঙ্কে গা ভাসিয়েছেন বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নববর্ষ সংখ্যা সানন্দায় তিনি ‘মাত্র দশ-বারো ক্রোশ দূর’ নামে একটি গল্প লিখেছেন। সেই গল্পে তিনি দেখিয়েছেন সিরাজদৌলা লম্পট, বদমায়েশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুনীল আমার মতো অখ্যাত নন, বিখ্যাত লেখক। তার সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলতে বাধে আমার। কিন্তু সত্যের স্বার্থে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তিনি তার রক্ত ও মগজে বহন করে চলেছেন সেই ঔপনিবেশিক শাসক তথা সাম্রাজ্যবাদের দালালদের উত্তরাধিকার। নইলে এই ফালতু কথা তিনি লিখতে পারতেন না।
টেনিসন তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক ‘বেকেট’-এর ভূমিকায়, তার নাটকে স্থান পাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বিদেহী আত্মার উদ্দেশে একটি চমত্কার চতুর্দশপদী কবিতা লেখেন। তার কয়েকটি চরণ খুবই চমত্কার :
“আমি যদি তোমাদিগকে এমন কথা বলাই,
যাহা তোমরা বল নাই—
যদি তোমাদের সদগুণ বিলুপ্ত করিয়া ফেলি,
এবং তোমাদিগকে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে গঠন করি,
তাহা হইলে হে প্রাচীন প্রেতাত্মাগণ
আমার উপর ক্রুদ্ধ হইও না।
কারণ যিনি আমাদিগকে ঠিক জানেন,
তিনি জানেন, যে কেউই নিজের একদিনের
জীবনের যথার্থ বৃত্তান্ত লিখিতে পারে না,
পৃথিবীতে আর কেহই তাহার জন্য লিখিয়া দিতে পারে না।”
যদি এরকম দায়বদ্ধতা কারও মধ্যে থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি যত বড় লেখকই হন, নিজের পাপকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ঘাড় উঁচু করে বলবেন না, ‘উপন্যাস লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলবদ্ধ নহেন। ইচ্ছামত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় নিতে পারেন।’
a_hyesikder@yahoo.com

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

দীপুর বচন : কালামে আবুল মা’ল : ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ’



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কালো বিড়াল, দিলীপ বড়ুয়ার প্লট প্রাপ্তি, ইনু এমপির খালেদা খেদানোর হম্বিতম্বি, আহাদ আলী সরকারের ছেড়া পাঞ্জাবি-তত্ত্ব কিংবা লতিফ বিশ্বাসের ৭-তলা বাড়ি আমার আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। গত সাড়ে ৩ বছরে আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ যেসব কীর্তি-কাহিনী স্থাপন করেছেন, তা হয়তো পর্যায়ক্রমে আরও সবিস্তারে জানা যাবে।
আমার চোখের সামনে এখন মানুষ। নাফ নদীতে ভাসমান মানুষ। তাদের ক্ষুধার্ত আতঙ্কিত স্বজন পরিজন। তাদের পেছনে মৃত্যু, অগ্নিসংযোগ, মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং লুণ্ঠন বাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বরতার পৈশাচিক উল্লাস। ওই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে ছুটে আসছে বাংলাদেশে, বাঁচার জন্য, আশ্রয়ের জন্য। নাফের পানিতে লাশ। মাথার উপরে ঝড় বৃষ্টি। উত্তাল ঢেউয়ে ডুবু ডুবু তাদের নৌকা ভরা ভয় আর ক্ষুধা।
ফিলিস্তিনিদের মতো রোহিঙ্গাদেরও কেউ নেই। তারা যে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে সেই বাংলাদেশ সরকার বেঁকে বসেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সরকার হুঙ্কার দিয়ে বসেছে, আর ১ জন রোহিঙ্গাকেও এদেশে আশ্রয় দেয়া হবে না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
পেছনে মৃত্যু। সামনে বাধার বিন্দ্যাচল। নিচে পানি। ওপরে খোলা আকাশ। মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে তারা যখন ভাসছে আর কাঁদছে, সেই সময় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দাঁড়িয়ে ৩০০ বিধিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তার বক্তব্য পেশ করছিলেন। তার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ছিল দেখার মতো। কণ্ঠে ছিল অসীম দৃঢ়তা (উনারা শক্তের ভক্ত নরমের জম, লোকে বলে)। দুর্বল প্রতিপক্ষ পেলে জবান পুরোদস্তুর খুলে যায়। তার কথার সংক্ষিপ্তসার হলো, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে আমরা স্বাক্ষর কিংবা অনুস্বাক্ষর করিনি। আন্তর্জাতিক আইনের কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের ওপর নেই। প্রথাগত আইনের কোনো দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা কোনো শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য নই। তাদের জন্য আমরা আমাদের দেশের সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য নই।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই যে তার কণ্ঠ দিয়ে প্রচুর লাল মরিচের গুঁড়া বের হচ্ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সঙ্গে তিনি নতুন বাণী যুক্ত করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তার কথায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নাকি মিয়ানমারের রাখাইনদের হাতে রোহিঙ্গা নিধনের জন্য দায়ী। তারাই নাকি মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের উসকে দিয়ে এসেছে।
হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না। দীপু মনি ডাক্তার মানুষ। তার মাথায় গোলমাল আছে তাও বলার সাহস পাচ্ছি না। তবে ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলে কেষ্টা বেটাই চোর’ নামক রোগটি আওয়ামী কর্তাদের অতি পুরনো ব্যাধি। এবার তারা তাদের সে ব্যাধিকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেন। দেশের সীমানার বাইরেও এখন থেকে যা কিছু যেখানে ঘটবে তার সব দোষ ধরে নিতে হবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর।
তো জামায়াতের নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে কী করছেন সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে ডা. দীপু মনির এই বিখ্যাত আভিধানিকভাবে নির্ভুল বাক্য বর্ষণ সেদিন শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল যেন মধ্যযুগীয় রক্তপিপাসু চেঙ্গিস খান কিংবা বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকু খানের প্রেতাত্মা যেন বহু শতাব্দী পরে মহিলা রূপ ধরে আমাদের পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। যেন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে, চমত্কার পারফিউম গায়ে মেখে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন। তার ঠোঁট ও জিহ্বাকে সেদিন আমার মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল ওগুলো হৃদয়হীন পাথর কিংবা লোহায় তৈরি। আর মাননীয় মন্ত্রীকে মনে হচ্ছিল বিমানবিক রোবট। ন্যায়, নীতি, মানবতা, এগুলো যার কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। শুধু অভিধানই সত্য। মনে হচ্ছিল সেই কবিতার পঙক্তি :
‘বালিকা ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
পড়েছে ব্যাকরণ, পড়েছে মূল বই।’

—নইলে ভুপেন হাজারিকার গানের গন্ধ থাকতো তার কণ্ঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না।’
দেড় হাজার বছর আগে পবিত্র কোরআন বলে গেছে, ‘মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত।’ ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি চণ্ডীদাস বলে গেছেন,
‘শুনহে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’
এই একই বাণীর অনুরণন পাই বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ জাতীয় কবি নজরুলের মধ্যে কবিতায় :
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।’

‘বালিকা’ দীপু মনি ‘বাফার স্টেট’ বোঝে না। তিনি এত বড় বড় নীতিকথার নির্গলিতার্থ অনুধাবন করবেন কী করে! তার সমস্যাটা আমাদের বুঝতে হবে। তিনি যে কালচারের মধ্যে বড় হয়েছেন তার মূল কথা হলো, ‘অনুকূল বাতাসে বেড়ে ওঠো, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লুকিয়ে পড়।’ বিপদ যতক্ষণ নাই ততক্ষণ গলা ফাটাও। বিপদ দেখলে নেতার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে শপথ নিতে ছুটে যাও। অথবা গর্তে ঢুকে পড়।
লজ্জা নারীর ভূষণ হলেও আমরা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নারী ও পুরুষের বাইরেই দেখি। নইলে তিনি শরমের মাথা খেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রসঙ্গ টানতেন না। টানলেও সঠিকভাবেই টানতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। হয়তো দেখেননি। দেখলে রোহিঙ্গাদের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতে পারতেন না। আমাদের অবস্থা ’৭১ সালে যা ছিল আজকের রোহিঙ্গাদের অবস্থা তা-ই। পার্থক্য, আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম আর হতভাগা রোহিঙ্গারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে রত।
পাকিস্তানের নিজস্ব সমস্যা বলে ভারত যদি তাদের খুনি বিএসএফকে বর্ডার নিশ্ছিদ্র করার আদেশ দিত, তাহলে আমাদের কী হতো? দীপু মনিকে ভেবে দেখতে বলি।
আমাদের সংবিধান তো পরিষ্কারভাবে বলে মানুষ ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াও। শোষিত বঞ্চিত নিগৃহীতের পাশে দাঁড়াও। আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দাও। ক্ষুধার্তকে খাবার দাও।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে যে কোনো বিচারেই ডা, দীপু মনির বক্তব্য মানবতাবিরোধী তো বটেই, একইসঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসেরও পরিপন্থী।
মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর জন্য কোনো কুপরামর্শ দীপুকে কেউ দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ একবাক্যে বলবে, ‘ফ্লাইং পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ হিসেবে যে খ্যাতি ও সুনাম আপনার আছে, তা কাজে লাগিয়ে দয়া করে একবার ইয়াঙ্গুন ঘুরে আসুন। প্রয়োজনে জাতিসংঘে যান। বড় বড় দেশগুলোতে যান। তাদেরকে বাংলাদেশের সমস্যাটা বলুন। রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর পথ বােল দিন। যেভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব চষে বেড়িয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
তা না করে তোতাপাখির মতো, দায়িত্বজ্ঞানহীন অবোধ প্রাণীদের মতো মিয়ানমারের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বাণী দেবেন—সেটা খুব খারাপ কাজ হবে।

দুই
আমাদের রাজনীতিতে ‘বাংলিস’ ভাষার উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর। বাংলিস ভাষা মানে বাংলা ও ইংরেজি মিশেল। একটা জগাখিচুড়ি। এটা আবার হতে হবে একই বাক্যবন্দের মধ্যে। তাইতো তিনি বলেছিলেন, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।’
এই আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর অন্যান্য আবিষ্কারকের মতো বাবরকেও সহ্য করতে হয়েছে অনেক গঞ্জনা, গালমন্দ, ঠাট্টা, ইয়ার্কি। তিনি সেসব নীরবে হজম করেছিলেন। কিন্তু তার আবিষ্কার যে এতদিনেও বৃথা হয়ে যায়নি, এটা যে ছিল সত্যি একটা নতুন জিনিস এবং দরকারি তা আবারও প্রমাণ করলেন আমাদের বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মা’ল আবদুল মুহিত। বাবরের এই বাংলিস ভাষা বিস্তারের নিশান এবার তিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে হাতে তুলে নিয়েছেন। বাবরের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি পরম মমতায় আপন কাঁধে তুলে নিয়ে সূচনা করেছেন নতুন যুগের।
শেয়ারবাজার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের গত ১৩ জুন বলেছেন, শেয়ার মার্কেট যথাযথভাবে কাজ করছে না। ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ।’ তিনি রাজ্যির বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন, তবে এই দুষ্টু বাজারের জন্য যেটা ওষুধ সেটা আসছে।
শেয়ার বাজারের প্রতি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নতুন নয়। এর আগেও তিনি অনেক উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে জাতিকে ফেড আপ করে ছেড়েছেন। এবার তার এই ‘বাংলিস’ শব্দ ব্যবহারের কারণে যা একটু নড়েচড়ে বসেছে সবাই।
তার এই বাংলিস ব্যবহারের সাহস ও প্রচেষ্টা দেখে নিশ্চয়ই কারান্তরালের নির্জন কক্ষে বসে বাবর সাহেব বেশ কৌতুক অনুভব করছেন। সেই কৌতুকের ছিটেফোঁটায় দেশবাসীও আজ আপ্লুত।
মুহিত সাহেব প্রবীণ মানুষ। অনেক তার নামডাক। তিনি আমাদের মধ্যে আরও দীর্ঘদিন বাঁচুন। তার সম্পর্কে কটুবাক্য ব্যবহার করা অসমীচীন হবে। তবে তার সম্মানে একটা মানপত্র কিংবা এক ধরনের এপিটাফের খসড়া করে পাঠিয়েছেন আমাদের এক পাঠক। সেটিই তুলে ধরছি :
ক) এখানে শুয়ে আছেন এমন একজন যিনি বাংলিস ভাষা প্রচলনে অপরিসীম গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন।
খ) শেয়ারবাজারকে গোরস্থান বানিয়ে সেই গোরস্থানে ৩৩ লাখ লগ্নিকারীকে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে তিনি অমর কীর্তি স্থাপন করে গেছেন।
গ) তিনি এমন একজন ছিলেন যিনি শেয়ারবাজারকে কখনও ফটকা বাজার, কখনও দুষ্টু বাজার, লগ্নিকারীদের জুয়াড়ি বলে আখ্যায়িত করে অপূর্ব বচনামৃত বর্ষণ করে গেছেন।
ঘ) তিনি কথায় কথায় রাবিশ শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস হিলারি ক্লিনটন এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও ‘রাবিশ’ বলে গাল দেন। এই রাবিশ তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিল।
ঙ) তিনি সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এক প্রিয় দালাল হয়ে প্রচুর কালিয়া-কোপতা, বিরিয়ানি, পায়েস খেয়ে হজম করে, অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হতে পেরেছিলেন। অতঃপর বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে গেছেন।
চ) আরেক ‘আবুল’ যে পদ্মা সেতু করতে পারলো না তার জন্যও নাকি আমাদের এই মহান ‘আবুল’ দায়ী। অবশ্য আল্লাহ সব ভালো জানেন।

তিন
মানুষ যখন দুর্ভিক্ষে মরছিল তখন আওয়ামী লীগের নেতা-এমপিরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছিল। তাদের সৃষ্ট গডফাদারদের হাতে যখন মানুষ মরছিল তখনও নির্বিকার ছিল এই দলের লুণ্ঠন মানসিকতা। এবারও বলাবাহুল্য, গুম খুনের মচ্ছব চললেও সৈয়দ আবুল হোসেনদের হাসি ফুরায় না। এই হাসির কিঞ্চিত্ নতিজা পেশ করেছেন তরুণ এমপি গোলাম মওলা রনি। তার নাকি সবকিছুতেই হাসি পায়।
তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘একবার বাস খাদে পড়ে গেল। অনেক আহত হলো। তিনি তা দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। দৌড়ে নিকটস্থ শস্য ক্ষেতে গিয়ে এক পেট হাসলেন।’
আরেকবার নৌ দুর্ঘটনার মধ্যেও তার হাসি পেয়েছিল। বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে ছেলেমেয়ে, বুড়া-গুঁড়া সবাই কান্না শুরু করলো। কাঁদলে একেকজন একেক রকম মুখভঙ্গি করেন। চিত্কারের শব্দও ভিন্ন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে আবার দেখায় দরদ। তিনি হাসি থামাতে পারলেন না।
নিজেই আবার লিখেছেন, বিক্ষুব্ধ লোকজন সেদিন আমাকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
প্রিয় পাঠক, দেশকে, দেশের মানুষকে দুঃখের দরিয়ায় ডুবিয়ে, দম্ভ করে যারা কথা বলে, বাজে আচরণ করে, নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক ভঙ্গিতে হাসে, সত্যি সত্যি তাদের উপযুক্ত ওষুধ হলো লঞ্চ থেকে পানিতে ফেলে দেয়া। গোলাম মওলা রনি তার বিকৃত রুচির হাসির ফিরিস্তি দিতে গিয়ে জাতিকে এর প্রতিবিধানের পথও বাতলে দিয়েছেন। এই তরুণ এমপি মহোদয়কে সে জন্য ধন্যবাদ।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

জসীমউদ্দীনের ‘মাইনক্যা’ : ‘অজ্ঞ রাষ্ট্রদ্রোহী’ স্পিকার ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত স্যাডিস্ট’ বিচারপতি



আবদুল হাই শিকদার
এক
জনগণ শিহরিত। কম্পিত। আতঙ্কিত। স্তম্ভিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব দেখে তারা বিব্রত, বিচলিত, হতাশ। দেশে হচ্ছেটা কি?
সড়ক ভবন নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে ২৯ মে জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেছিলেন, সরকার, সংসদ ও বিচার বিভাগ যে কোনো প্রতিষ্ঠান সীমা লঙ্ঘন করলে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তিনি আরও বলেছিলেন, আদালত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা ভালো দেখায় না। কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।
এই বক্তব্যের পর যথারীতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বিষয়টি আদালতের গোচরে আনলে বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী যা বলেন তার সারসংক্ষেপ হলো, এটা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। স্পিকার সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকানি দিয়েছেন। তার বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। স্পিকার তার পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। ওই পদে থাকার অধিকার তার নেই। স্পিকারের মন্তব্য আনপ্রিসিডেন্টেড। তিনি একজন আইনজীবী। তার তো অ্যাডভোকেট পদ ব্যবহার করা উচিত নয়। স্পিকারের মনে হয় বিচার বিভাগ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। স্পিকার তার অজ্ঞতা দেখিয়েছেন। একজন স্পিকার এত অজ্ঞ হতে পারেন, তা আমরা ভাবতে পারি না। স্পিকারের বক্তব্য শুধু অজ্ঞতাই নয়, তার বক্তব্য অমার্জনীয়। (স্পিকার সংসদের প্রতীক) ওই প্রতীক হতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। পড়ালেখা জানতে হয়। এটা হলো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর।
বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর এই বক্তব্যের পর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সংসদ সদস্যরা। তারা পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সার্বভৌম সংসদের ওপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী মানিক হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দয়ায়। কোনো লিখিত পরীক্ষা ও যোগ্যতা ছাড়াই তিনি বিচারপতি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার গত আমলে এ লোককে যোগ্যতা ছাড়া, পরীক্ষা ছাড়া হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ করেছে। এ ব্যক্তি বিচারক হওয়ার পর সারাদেশের সচিব, আইজিসহ যত ভদ্রলোক আছেন তাদের সামান্য কারণে হাইকোর্টে ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে বেইজ্জতি করেন। এ বিচারপতি সেই ব্যক্তি-যিনি বিমানে সামনের আসনে বসার জন্য বিমানের এমডিকে হাইকোর্টে ডেকে বেইজ্জতি করেছেন। এই ব্যক্তি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। তিনি কোনো সুস্থ মানুষ নন।
শামসুদ্দিন মানিক ভাগ্যবান। আমাদের আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে তাকে বিচারক করেছেন। বিএনপি তাকে কনফার্ম করেনি। আমরা এবার ক্ষমতায় আসার পর তাকে কনফার্ম করেছি। তিনি আজ আমাদের বিরুদ্ধে, পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে মন্তব্য করছেন। আর একজন আইনজীবী আছেন মনজিল মোরশেদ। তার কোনো কাজ নেই। খবরের কাগজ পড়ে শামসুদ্দিন মানিকের কাছে যান এবং তিনি রুল ইস্যু করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আমরাই স্লোগান তুলেছিলাম, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা। এ স্লোগানে প্রতিরোধ গড়ার পর আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি লুঙ্গি পরে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
শামসুদ্দিন মানিক একজন স্যাডিস্ট। তিনি মানুষকে অপমান করে মজা পান। তা না হলে একজন ট্রাফিক পুলিশ, যিনি হয়তো তাকে দেখেননি, স্যালুট না দেয়ায় গাড়ি থেকে নেমে তাকে কানে ধরে উঠবস করিয়েছেন। ইত্যাদি।
জাতীয় সংসদ ও উচ্চ আদালতের এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান আমাদের দেশে অভূতপূর্ব। শাসকগোষ্ঠীর নানা কুকীর্তি, দুর্নীতি, ঔদ্ধত্য ও সীমা লঙ্ঘনের কালচার এবং হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার প্রতিফলন ঘটেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তাদের অন্তর্গত বিরোধ বহুদিন থেকেই ফুঁসছিল। এবার সেই বিরোধ ফুলে-ফেঁপে পেকে বিস্ফোরিত হয়েছে। আর এর দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় জীবনের সর্বত্র। আর হতবাক জনগণকে শুনতে হচ্ছে তাদের সংসদ পরিচালিত হচ্ছে একজন ‘অজ্ঞ রাষ্ট্রদ্রোহী’ স্পিকার দ্বারা আর বিচারব্যবস্থা পড়েছে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত স্যাডিস্ট’ বিচারপতির খপ্পরে।
এখন এই বিচারপতিকে ইমপিচ করতে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে সংসদ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর দাবি উঠেছে। এই দাবির পর গত বুধবার এজলাশে বসেননি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। অন্যদিকে অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনও চলে গেছে।
অবশ্য আশার কথা, সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, একজন বিচারকের দায় গোটা জুডিশিয়ারি বহন করতে পারে না।
আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রেরই বারোটা বাজিয়েছে এই সরকার। এক্ষেত্রে কি হয় তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি কি? অন্যদিকে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে গণতন্ত্র।
দুই
১৯৫৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মঞ্চে প্রথমবারের মতো অভিনীত হয় কবি জসীমউদ্দীনের অতি বিখ্যাত নাটক ‘বেদের মেয়ে’। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেন বহির্বিশ্বে।
আজকের লেখা শুরুর সময় আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা হাতড়ে দেখি বইটি নেই। শরণাপন্ন হলাম বাংলাবাজারের প্রকাশক বন্ধু এম আর মিলনের। তিনি বইটি জোগাড় করে তড়িঘড়ি আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। তাতেই রক্ষা হলো।
তো এই নাটকে একটি চরিত্র আছে ‘মানিক’ নামে। নাটকে যাকে বার বার ‘মাইনক্যা’ নামে ডাকা হয়। মাইনক্যা হাড়বজ্জাত। গ্রামের মোড়ল সাহেবের সব অপকর্মের দোসর। কখনও সে নিজে থেকেও মোড়লকে জড়িত করে নানা পাপে। আবার মোড়লও তাকে দিয়ে দেখিয়ে বেড়ায় নিজের ক্ষমতা।
এই মাইনক্যা একদিন খবর নিয়ে আসে মোড়লের কাছে। গ্রামে এবার যে বেদের বহর এসেছে তাদের মধ্যে ‘সুডৌল সোন্দর হলদে পঙ্খীর বাচ্চার মতো’ এক বাইদানী এসেছে। নাম চম্পা। মাইনক্যার প্ররোচনায় মোড়লের মাথায় ভর করে শয়তানি। বেদেদের সবাইকে ডেকে আনে মাইনক্যা মোড়ল সাহেবের বৈঠকখানায়। সেখানে বেদের সরদার চম্পা বাইদানীর স্বামী গয়া বেদেকে মোড়ল বলে, ‘শোন বাইদ্যা, তোমার বাইদানীরে আমি চাই।’
গয়া বেদে বললো, ‘মোড়ল সাহেব! আমরা বাইদ্যা জাত, ঘর নাই, বাড়ি নাই। দ্যাশে দ্যাশে ঘুইরা বেড়াই। পথের মা আমাগো মা, পথের বাপ আমাগো বাপ। ওমন কথা কইয়েন না। আপনাগো বল-ভরসাতেই আমরা ঘুইরা ফিরি।’
মোড়ল বললো, ‘দেখ বাইদ্যা। ওসব কাকুতি মিন্নতির কথা নয়। সুজা কথায় যদি তোমার বাইদানীরে দিয়া যাইবা ত দিয়া যাও, নইলে কি আমি করবার পারি—ক’ দেহি মাইনক্যা। ক’ ত?’
মাইনক্যা জানে তাকে কি বলতে হবে। সে উচ্চকণ্ঠে বললো, ‘মোড়ল সাব। আপনি কি করবার পারেন, তা কি আর কইতিই অবি? ওইত সেবার কুতুবদ্দি একটু তেড়িবেড়ি করছিল, তার বাড়িতি আগুন জ্বালায়া, ভিটার উপর নাঙ্গল চাষ্যা বাগুনির খ্যাত লাগায়া দিছিলেন; কুতুবুদ্দিরে পদ্মা নদীতে ফেইল্যা দিছিলেন; গাজনডাঙ্গার ছমিরদ্দি...’
চামচার বর্ণনায় তৃপ্ত মোড়ল গয়া বেদেকে বলে, ‘বুঝলা’। গয়া বেদে কাকুতি মিনতি করে। রাতের মধ্যেই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি চায়। ক্রুদ্ধ মোড়ল মাইনক্যাকে বলে, ‘গ্রাম ছাইড়া যাবি? ক’ তো, ক’ তোরে মাইনক্যা—কি ঠিক কইরা রাইখ্যাছি আজ?
মাইনক্যা মোড়লের যথার্থ সহচর। সে বলে, ‘আজ রাইতে সমস্ত বাইদ্যার নাও ভাইঙ্গা চুরমার কইরা দিবেন, সমস্ত বাইদ্যার গলা কাইট্টা ফালাইবেন।’
গয়া বেদে বলে, ‘দোহাই দোহাই, মোড়ল সায়েব।’
মোড়লের সে দিক ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার চামচা মাইনক্যাকে বলে, ‘এহনই কি, ক’ রে ক মাইনক্যা! আরও কি করবো আমি, আমার হুকুমডা কয়া দে।’
মাইনক্যা তো আসলে মোড়লের মাইক্রোফোন। সে বলে, ‘বাইদ্যা-নৌকার যত পুলাপান ছোট ছেলে আছে তাগো আছড়াইয়া মারবেন। সব বাইদ্যানীর মাথার চুল কাইটা বে-বস্ত্র কইরা দেশ থইনে খেদায়া দিবেন। আর সেই সোন্দর বাইদানীরে ধইরা রাখবেন।’
মাইনক্যার মুখে নিজের ক্ষমতার কথা শুনে বিগলিত মোড়ল বললো, ‘হুনছস বাইদ্যা! কি রকম পেরতাবডা আমার!’
এরপর আর কি। এই মাইনক্যার জন্য গ্রামে ঘনিয়ে আসে বিপদ। বেদেদের সহজ স্বাভাবিক ছান্দিক জীবনধারা তছনছ হয়ে যায়। আর নষ্ট হয়ে যায় চম্পার জীবন। কবি জসীম উদদীনের ‘বেদের মেয়ে’ পরিণত হয় এক হৃদয়ভাঙা ট্রাজেডিতে। এই ‘মাইনক্যা’দের সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে অভিশাপ। কারণ এরা হলো অকল্যাণ ও অমঙ্গলের প্রতীক।
তিন
একবার এক অযোগ্য শীতার্ত ইঁদুরকে এক দয়ালু মুনি রক্ষা করেছিলেন। ইঁদুর একদিন বললো, বিড়াল তাকে মারতে আসে। মুনির বরে ইঁদুর বিড়াল হয়ে গেল। এরপর কুকুরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মুনির বরে বিড়াল থেকে কুকুর হয়ে গেল ইঁদুর। একদিন বললো বনের বাঘ তাকে খেতে আসে। মুনির বরে ইঁদুর কুকুর থেকে পরিণত হলো বাঘে। তারপর একদিন মুনির উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লো ব্যাঘ্ররূপী ইঁদুর। মুনি বললেন, আচ্ছা, তুই আবার ইঁদুর হয়ে যা। ইঁদুর আবার ইঁদুর হয়ে গেল।
আজকের দিনে আমরা, আমাদের শাসকরা যেসব বাঘ বানাই সেগুলোও সেই ইঁদুরের মতো তার স্রষ্টাকেই শেষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। কারণ আজকালকার মুনিদের বাঘ থেকে ইঁদুরে পরিণত করার মতো সততা থাকে না।
যদিও শেষ পর্যন্ত দুষ্টু ছেলেটির মতো পরিণতি কারো কারো হয়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে দুষ্টু ছেলেটি। পথচারী কেউ এলে আচমকা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে পেছন থেকে।
তারপর বিকৃত আনন্দে ফেটে পড়ে। একবার এভাবে আক্রান্ত এক পথচারী তাকে ১০টি টাকা উপহার দিয়ে বললো, খুব ভালো মারতে পার তুমি। তবে এখন যে লোকটি এখান দিয়ে যাবে তাকে যদি মারতে পার তাহলে সে তোমাকে ১০০ টাকা বকশিশ দেবে। টাকার লোভে ছেলেটি অপেক্ষা করতে লাগলো ঝোপের মধ্যে। কিছুক্ষণ পর সেই লোকটি এলো। ছেলেটি যথারীতি তার ওপর পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠিপেটা করে হি হি করে হাসতে হাসতে বললো, এবার আমার ১০০ টাকা দাও।
ছেলেটির দুর্ভাগ্য, ওই লোকটি ছিল একজন বদরাগী পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মুহূর্তের মধ্যে এই ছেলেটিকে পাকড়াও করে ফেললেন। তারপর লোকজন নিয়ে গোটা গ্রাম ঘেরাও করে ছেলেটির পিতামাতাসহ সবাইকে বেধড়ক পেটালেন। সবাইকে বেঁধে নিয়ে চললেন, থানায়। কেন তারা এরকম বজ্জাত ছেলে জন্ম দিয়েছে? কেন তাকে আদব-কায়দা শেখায়নি?
কথায় বলে লোভে পাপ। পাপে হয় মৃত্যু। আর সীমা লঙ্ঘন না করার জন্য সব ধর্মেই বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
চার
কবি শেলীর স্ত্রী ছিলেন মেরী শেলী। কিন্তু কবি শেলীর স্ত্রী হিসেবে নয়, বিশ্ব সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে আছেন তার বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ফ্রাংকেনস্টাইনের জন্য। বৈজ্ঞানিক ফ্রাংকেনস্টাইন এক যন্ত্রদানব তৈরি করেছিলেন অন্যদের ওপর নিজের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য। দুঃখের বিষয়, এই দানবের হাতেই শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিয়ে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছিল তাকে।
মেরী শেলীর ফ্রাংকেনস্টাইন আজ আর মাত্র একটি গ্রন্থ নয়। এটা একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত, অনন্যসাধারণ শিক্ষা হিসেবে অমর হয়ে আছে। আমাদের গ্রাম্য প্রবাদ, অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়—এটাই ফ্রাংকেনস্টাইনের মর্মবাণী। সেই বাণী থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা জ্ঞানী-গুণীরা বলে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা কখনোই শোনে না।
আমাদের মনে রাখা দরকার রাজা আর বানরের গল্পটি। দূরের পাহাড় থেকে প্রতিদিন একটি করে মোহর এনে দেয় বানর। রাজা মোহর হাতে নিয়েই বানরকে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করেন। বানর ব্যথা পেয়ে দূরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। প্রতিদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। উজির নাজিররা রাজাকে বললেন, এটা ঠিক না। এটা অন্যায়।
রাজা বললেন, ঠিক আছে। লাঠিপেটা বন্ধ। পরদিন বানর যথারীতি মোহর আনলো। রাজা বানরকে মারলেন না। বানর অভ্যাস মোতাবেক দূরে গিয়ে বসে রইল। পরদিন বানর মোহর দিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসে রইল। তারপর দিন বসলো রাজার কাছেই। তারপর দিন মোহর দিয়েই বানর গিয়ে বসলো রাজার ঘাড়ে। রাজা এবার উজির নাজিরদের ডেকে বললেন, বোঝা গেল বিষয়টা? কেন ওকে লাঠিপেটা করি। কেন এই নিয়ন্ত্রণটুকু দরকার?
এই অতি দরকারী জিনিসটা যদি আমাদের কর্তারা বুঝে থাকেন, তাহলে ভালো। না বুঝলেও ক্ষতি নেই। কারণ তাদের গাছের গোড়া মারাত্মকভাবে পচে গেছে। এই গাছ কাটার জন্য আর কোনো কাঠুরিয়ার দরকার হবে না। আপনাআপনি এটা ভূপতিত হবে। আমাদের মতো আমজনতার শুধু একটু অপেক্ষা করতে হবে—এই যা।
a_hyesikder@yahoo.com