আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
‘তোমার চোখের মতো স্নিগ্ধ চোখ পৃথিবীতে নেই,
এবং কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র
আর প্রসব করেনি এই পৃথিবীর বুকে’
—কবি হাসান বিন সাবিত।
[রসুলের সাহাবী]
‘বালাগাল উলা বে কামালিহি
কাশাফাদুজা বে জামালিহি
হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
—শেখ সা’দী।
‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়,
রূপ-কাঠের নৌকা খানি
নাহি ডোবার ভয়।
নবী না চেনে যারা
মুয়াহেদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার তাই মজুরী
দলিলে সাফ দেখা যায়।’
—লালন ফকির।
‘দেখ ঐ গিরি প্রস্রবণ আনন্দে উজ্জ্বল
যেন তারার এক চমক, মেঘের উপরে
পালে তারে তরুণ বয়সে সদয় আত্মিকগণ
চূড়াগণ মধ্যবর্তী ঝোপের মাঝারে।’
—গ্যাটে।
[হজরত মুহম্মদ গীতি]।
“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some reader’s and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular level.”
ÑMichael H Hart
[The 100 : A Ranking of the most influential persons in history]
[ বশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় আমি যে মোহাম্মদকে প্রথমে রেখেছি তাতে কিছু পাঠক বিস্মিত হতে পারেন, কেউ কেউ প্রশ্নও তুলতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ইহজাগতিক উভয় স্তরে সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছেন।’
—মাইকেল এইচ হার্ট। [দি ১০০ : এ র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পার্সনস ইন হিস্টরি]
‘আমি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিশ্চিত হয়েছি যে, সেই কঠিন সময়ে ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল তরবারির মাধ্যমে নয়, বরং তার সরলতা ও ইসলামের নবীর নম্রতার মাধ্যমে। তাঁর অঙ্গীকার পূরণের দৃঢ়তা, তার বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য তাঁর মমতা, তাঁর নির্ভীকতা, সাহস, সৃষ্টিকর্তা এবং নিজের কাজের ওপর আস্থা। তরবারি নয় বরং এসবই ছিল আসল কারণ। যার দ্বারা তিনি প্রতিহত করছিলেন সকল ধরনের বিপদ।’
—মহাত্মা গান্ধী।
[Young India, 1924]|
‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ,
সেই পথে মোর চলে যেতেন নূরনবী হযরত।
পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,
আমি, ঝরনা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে,
সেথা, দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত\’
—কাজী নজরুল ইসলাম।
ওপরের উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করলাম ইচ্ছে করে। কারণ আমার হৃদয় বেদনায় জর্জরিত। আমার বোধশক্তি তিরোহিত। আমি হতবাক, আমি স্তম্ভিত। আমি আতঙ্কিত। এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাসে রাসুলের (সা.) চরম শত্রুরা যা কখনও কল্পনাও করেনি, সালমান রুশদির মতো সাম্রাজ্যবাদের গৃহপালিত লেখকও যে ভাষা ব্যবহার করতে সাহস পায়নি, এমনকি ধর্মান্ধ ক্রুসেডাররাও যে ভাষা ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ করেছে, তার চাইতেও নোংরা, জঘন্য, অশ্লীল, হিংস্র ও অসভ্য ভাষা ব্যবহার করেছে রাজীবসহ আরও কয়েকজন ব্লগার। যারা ব্লগার নামেরও কলঙ্ক। ডধত্ ডড়ষভ-এর মতো জিঘাংসা নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাসুলের পবিত্র নামের ওপর। আশ্চর্যের বিষয় এদের কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নয়, সবাই মুসলমান অথবা মুসলিম পরিবারের সন্তান। এদের কেউই এলিয়েন নয়, কোনো জন্তু-জানোয়ার নয়। এরাও মানুষ! কোনো না কোনো নারীর জঠরে এদের জন্ম।
এরা যদি মানুষ হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষ শব্দটি তার তাত্পর্য হারিয়ে ফেলেছে। এরা যদি নাস্তিক হয় তাহলেও বুঝতে হবে এরা ভণ্ড নাস্তিক। এরা নাস্তিক হওয়ারও অযোগ্য। কারণ নাস্তিক্যবাদও এক ধরনের বিশ্বাস। একটা বিশ্বাস কখনোই অন্য একটি বিশ্বাসকে আহত করে না, অপমান করে না। এ প্রসঙ্গে মনীষী আহমদ শরীফের (যিনি একজন খাঁটি নাস্তিক ছিলেন) উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না—‘নাস্তিক হওয়া সহজ নয়।...তাই প্রাচীন ও আধুনিক দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত নাস্তিকই ছিলেন সুজন, সুনাগরিক ও মনীষী।’ রাজীব এবং তার সহচররা তো এই কথার ধারে-কাছেরও কেউ নয়। ওরা তো বন্য বরাহের চাইতেও দাঁতাল এবং কুিসত। চ্যানি বলেছেন, যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারাই যুবক। যারা ধর্মে অবিশ্বাসী তারাই বৃদ্ধ। তাহলে এরা যুবকও নয়, বৃদ্ধও নয়, এরা কদর্য-কোনো প্রাণী। যাদের উদ্দেশ্য হলো দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনা। হানাহানি ডেকে আনা। রক্তপাত ডেকে আনা।
ধর্ম হলো মানুষের গভীরতম, নিবিড়তম এক বিশ্বাস। তার সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান। সেই জায়গায় যেমন অন্যের প্রবেশাধিকার নেই, তেমনি তাকে অসম্মান করার অধিকারও কারও নেই। এজন্যই রবার্ট বার্টন বলেছেন, ‘ধর্ম মানব মনীষা আর উপলব্ধির এক দুর্লভ কৃতিত্ব আর সম্পদ। ধর্মের কাছে মানুষ পায় আত্মজ্ঞান, অতীন্দ্রিয় জিজ্ঞাসার প্রেরণা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধার শান্তি ও সান্ত্বনা। ধর্ম মানুষকে দেখিয়েছে বিশ্বাস, ভক্তি, বিনয়, ক্ষমা, করুণা আর আত্মনিবেদনের পথ, দিয়েছে শৃঙ্খলা আর সংযত জীবনের দীক্ষা।’ সেই স্থানে ড্রাকুলার মতো, শয়তানের মতো, গোঁয়ারের মতো আঘাত করেছে সরকারের নিয়োজিত হাতে-গোনা কয়েকজন ব্লগার।
আসলে এরা ব্লগার নয়, ব্লগারের ছদ্মবেশ পরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী।
পৃথিবীর দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের রাসুলকে করেছে চরম অপমান এবং তা এমন একসময় যখন সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র, রক্তপিপাসু ইসরাইল এবং আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাস, ভীতি এবং আতঙ্ক। উদ্দেশ্য ইসলাম নির্মূল।
সঙ্গত কারণেই এইসব তথাকথিত ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এরা এদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছে সম্প্রীতি, সমঝোতা ও শান্তির বিরুদ্ধে। উস্কে দিতে চেয়েছে আগুন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে বাংলাদেশকে। আর এদের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে একটি ব্যর্থ, অযোগ্য, অপদার্থ সরকার ও তাদের পা-চাটা গণমাধ্যম। যারা হারিয়ে ফেলেছে পেশাদারি সততা। সরকারের মতোই এরাও সাইকোপ্যাথ। যারা অন্ধের মতো সবকিছুর মধ্যে জামায়াত-শিবির খুঁজে বেড়ায়। আর চেপে যাচ্ছে সত্যকে।
দুই
আমাদের নেতা তখন আতিকুর রহমান সালু। পূর্ব পাকিস্তান বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের তিনি তখন সাধারণ সম্পাদক। সালু ভাই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির স্থপতি। আর আমি বলছি ষাটের দশকের শেষ দিককার কথা। সুদূর ভূরুঙ্গামারী থেকে রংপুর এসেছি তার এক জনসভায় যোগ দিতে। ফেরার পথে জড়িয়ে গেলাম হাঙ্গামায়। তখন তো বাহন বলতে কেবল ট্রেন। সেই ট্রেনে আমাদের কামরায় উঠলো ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা প্রথম থেকেই মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে আজেবাজে ভাষায় আক্রমণ শুরু করে দিল। আর মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ তখন আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা। আমরা অনুরোধ করলাম বাজে কথা না বলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা অশ্লীল ভাষার ব্যবহার থেকে বিরত হলো না। শুরু হলো প্রতিআক্রমণ। তারপর যা হয়। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। হাতাহাতি থেকে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। ট্রেনের যাত্রীরা ভয়ে চিত্কার শুরু করে দিল। থেমে গেল ট্রেন। ছুটে এলো গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ। তারাও থামাতে পারে না। এর মধ্যে ছাত্রলীগের দুই-তিন জনের মাথা ফেটে গেল। আমাদেরও কেউ কেউ রক্তাক্ত।
রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল করার জন্য যদি এত বড় কাণ্ড ঘটতে পারে, তাহলে ধর্মকে অপমান করলে, নবী, অবতারদের অপমান করলে কী ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
শুধু মুসলমান বলে কথা নয়, হিন্দুদের দেবদেবী, খ্রিস্টানদের যিশু কিংবা বৌদ্ধদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেও তারা একই রকমভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে পারে। এই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, যত ক্রুসেড হয়েছে অন্য কোনোকিছু নিয়ে এত নয়। ভারতে এখনও দাঙ্গাহাঙ্গামা নৈমিত্তিক ব্যাপার। এজন্যই অন্য ধর্মের লোকদের গালমন্দ করার ব্যাপারে কোরআন শরীফে নিষেধাজ্ঞা আছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ করো না। তাহলে তারাও ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে।’ [সুরা আল-আনয়াম]।
বলা হয়েছে ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ [ধর্মের বিষয়ে জোর-জবরদস্তি নেই]। হাদিসে আছে রাসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করবে, তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, কিংবা তাকে সাধ্যাতিত পরিশ্রম করাবে, তার অমতে তার কিছু ছিনতাই করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার প্রতিপক্ষ হবো।’
ইসলাম বলে, ‘অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করবে না। যদি তর্কবিতর্ক করতেই হয়, তাহলে তা করো উত্তম পন্থায়।’
আমি পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চাই আমি কোনো ধর্মবেত্তা নই। ইসলামী চিন্তাবিদ নই। সেই অর্থে প্র্যাকটিসিং মুসলিমও নই। তারপরও ইসলামের বিশ্বজনীন বাণীর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ প্রগাঢ়। সেজন্যই পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি, ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি সম্মানবোধ লালন করি অন্তরে। বিশ্বাস করি কোনো ধর্মই বিদ্বেষ ও হানাহানি নয়, মানুষে মানুষে প্রেম ও শান্তিকেই দিয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব।
ব্লগার রাজীবের অন্যায় ও অন্যায্য কাজ এবং তার সহচরদের সহযোগিতা, বাংলাদেশের মানুষের মতো আমাকেও ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত করেছে। বিশেষ করে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তারা যা লিখেছে তা এককথায় ক্ষমাহীন। সেজন্যই দেশজুড়ে জ্বলে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। ধর্মপ্রাণ মানুষজন পথে নেমেছে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে নয়, তারা পথে নেমেছে অপমানের বিরুদ্ধে, তাদের দাবি একটাই—এই ঔদ্ধত্য অবশ্যই দেশ, জাতি, ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে, কল্যাণ ও মঙ্গলের স্বার্থে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সময় ক্ষমতাসীন আছে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার, যারা এই ধর্মবিদ্বেষীদের পক্ষ অবলম্বন করে ধর্মপ্রাণ মানুষদের শায়েস্তা করার জন্য নামিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ তাদের দলীয় ঠাঙ্গারেদের। হামলা মামলায় জেরবার করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি শাহবাগের চত্বরের জমায়েতকে সামনে নিয়ে বিরোধী গণমাধ্যম বিশেষ করে আমার দেশ ও তার সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভির বিরুদ্ধে একের পর এক ছাড়ছে রণহুঙ্কার। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে জটিল কুটিল আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র। নতুন করে দেয়া হয়েছে মামলা। তিনি নাকি উস্কানি দিচ্ছেন। মাহমুদুর রহমান তো খবর ছাপিয়েছেন মাত্র। যারা উস্কানিদাতা তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। কিন্তু উস্কানিদাতাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে এখন উল্টো অভিযোগ চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের ওপর। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই রকম বিষোদগার ১৯৭৫ সালের পর আর এদেশে দেখা যায়নি। এখন দেয়া হচ্ছে আল্টিমেটাম, গ্রেফতারের হুমকি। শাহবাগের নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগের ক্যাডারদের পাশাপাশি এখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরাও স্বমূর্তি ধারণ করে বকছেন আবোল-তাবোল।
সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললে যে কাউকে পেতে হচ্ছে কঠিন দণ্ড। ঘটছে চাকরিচ্যুতি। এখন বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়ে পড়ছে ফালতু বিষয়। আর মহানবী (সা.)কে অপমান করলে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করলে পাওয়া যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। মহানবীর গালমন্দকারীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী উপাধি দেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’। তড়িঘড়ি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাতকারীর বাসায়। জানান সহানুভূতি। আর যারা ধর্মের অপমানের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। তাদের হত্যা করা হচ্ছে। কুকুর ও সাপের মতো তাদের পেটানো হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসাগুলো।
আধিপত্যবাদের তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলোও সরকারের পাপিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে কোরাস। তারা সাংবাদিকতা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীদের মতো জুলুমকারীকে বানাচ্ছে বীর। আর নির্যাতিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে অপপ্রচার। তাদেরকেই করছে দোষারোপ। সরকার এবং এই গণমাধ্যম পরিস্থিতিকে শান্ত করার বদলে উল্টো অপরাধীদের উস্কে দিচ্ছে আরও সহিংস হওয়ার জন্য। ধর্ম এবং আদালত দুটোরই এখন লাঞ্ছনার শেষ নেই এদেশে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমার দেশ যে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে, তার প্রশংসা করার বদলে তারা এখন পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর তাদের কর্কশ কণ্ঠকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
সঙ্গত কারণেই যে কারও পক্ষেই এই ধারণায় উপনীত হওয়া সহজ যে, সরকার ইসলাম ধর্ম এবং বিরোধী গণমাধ্যমকে পিষে মারার জন্য অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরকে দমন করার উসিলায় তারা আসলে দমন করতে চাচ্ছে সব বিরোধিতাকে। জামায়াত-শিবির দমন হলো তাদের উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়া। দেশকে ভেতর থেকে অকার্যকর করে দেয়া। সে জন্যই তাদের কাছে এ বিষয় স্পষ্ট যে শাহবাগ চত্বরের জমায়েত হচ্ছে তাদেরই ইচ্ছায়। তাদেরই নির্দেশে। সরকারি নানামাত্রিক ষড়যন্ত্রেরই একটি পর্যায় হলো শাহবাগ। সেজন্যই আজ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে কুত্সা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বলা হচ্ছে রাজাকার। শাহবাগ চত্বরের এমরান জাতীয় দলীয় লোকদের হম্বিতম্বি, নাসিরউদ্দিন ইউসুফদের আস্ফাালন ছাড়িয়ে গেছে মাত্রা। আর প্যান্ট খুলে গেছে সরকারের। সরকার ও শাহবাগ এখন একাকার।
সরকার ব্লগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করে তাদের লেলিয়ে দিয়েছে দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সব ধর্মবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে ডেকে আনছে সহিংসতা। ডেকে আনছে রক্তপাত।
সেজন্যই তাদের দলবাজ বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় হয়েছে অবতীর্ণ। ফলে নিজেদের বেলায় গণতন্ত্র, ১৭ দিন ধরে শাহবাগ দখল করে রাখলেও তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ একদিন মিছিল করলেই তা কবিরা গুনাহ হয়ে যায়। চমত্কার বাকশালী গণতন্ত্র!
তিন
ব্লগার রাজীব কিংবা তার দুষ্কর্মের দোসরদের দোষ দিয়ে সস্তা হাততালি পেতে চাই না আমি। দোষ তো বীজের। দোষ তো পরিবারের। দোষ তো বাবা-মা’র। দোষ তো সমাজের। দোষ রাষ্ট্রের। দোষ রাজনীতির। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। দোষ আমাদের পরিবেশের।
আমরা তো আমাদের সন্তানদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। যথার্থ শিক্ষা দেইনি। ব্যর্থ পিতামাতার ব্যর্থ শিক্ষা এবং ব্যর্থ রাজনীতির জরায়ু থেকে তো ভালো মানুষ জন্মানোর কোনো পথ নেই। ভালো মানুষ জন্মাতে পারে না। পারে না বলেই জন্ম হচ্ছে রাজীবের মতো, বাপ্পাদিত্যের মতো বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন সন্তানদের।
সেজন্যই অনুরোধ করি, আসুন জাতীয় জীবনের এই চরম দুর্যোগের দিনে, আমরা আমাদের সন্তানদের আবার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেই। ফিরিয়ে আনি হারিয়ে যাওয়া নীতি ও নৈতিক শিক্ষায়। তাদের স্বর্ণগর্ভ অতীত সম্পর্কে জ্ঞাত করাই। বর্তমানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করি। নিশ্চিত করি অনাগত ভবিষ্যত্। রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করি দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন দেশপ্রেম বর্জিত অসত্, ভণ্ড, প্রতারক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের। তাদেরকেও মাও সেতুঙের মতো, স্টালিনের মতো সংশোধনাগারে পাঠিয়ে আবার মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেই। জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরের মতো এই দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সরকারের লোকজনদেরও ধরে ধরে শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেখতে বাধ্য করি খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছায়াছবি।
কেবল তাহলেই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে শ্রেয়বোধগুলো। ফিরে আসবে মহত্ত্ব। নইলে নব্য বাকশালীদের জিঘাংসা গিলে খাবে আমাদের সব অর্জন। গিলে খাবে দেশটাকে।
a_hyesikder@yahoo.com
এবং কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র
আর প্রসব করেনি এই পৃথিবীর বুকে’
—কবি হাসান বিন সাবিত।
[রসুলের সাহাবী]
‘বালাগাল উলা বে কামালিহি
কাশাফাদুজা বে জামালিহি
হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
—শেখ সা’দী।
‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়,
রূপ-কাঠের নৌকা খানি
নাহি ডোবার ভয়।
নবী না চেনে যারা
মুয়াহেদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার তাই মজুরী
দলিলে সাফ দেখা যায়।’
—লালন ফকির।
‘দেখ ঐ গিরি প্রস্রবণ আনন্দে উজ্জ্বল
যেন তারার এক চমক, মেঘের উপরে
পালে তারে তরুণ বয়সে সদয় আত্মিকগণ
চূড়াগণ মধ্যবর্তী ঝোপের মাঝারে।’
—গ্যাটে।
[হজরত মুহম্মদ গীতি]।
“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some reader’s and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular level.”
ÑMichael H Hart
[The 100 : A Ranking of the most influential persons in history]
[ বশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় আমি যে মোহাম্মদকে প্রথমে রেখেছি তাতে কিছু পাঠক বিস্মিত হতে পারেন, কেউ কেউ প্রশ্নও তুলতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ইহজাগতিক উভয় স্তরে সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছেন।’
—মাইকেল এইচ হার্ট। [দি ১০০ : এ র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পার্সনস ইন হিস্টরি]
‘আমি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিশ্চিত হয়েছি যে, সেই কঠিন সময়ে ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল তরবারির মাধ্যমে নয়, বরং তার সরলতা ও ইসলামের নবীর নম্রতার মাধ্যমে। তাঁর অঙ্গীকার পূরণের দৃঢ়তা, তার বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য তাঁর মমতা, তাঁর নির্ভীকতা, সাহস, সৃষ্টিকর্তা এবং নিজের কাজের ওপর আস্থা। তরবারি নয় বরং এসবই ছিল আসল কারণ। যার দ্বারা তিনি প্রতিহত করছিলেন সকল ধরনের বিপদ।’
—মহাত্মা গান্ধী।
[Young India, 1924]|
‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ,
সেই পথে মোর চলে যেতেন নূরনবী হযরত।
পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,
আমি, ঝরনা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে,
সেথা, দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত\’
—কাজী নজরুল ইসলাম।
ওপরের উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করলাম ইচ্ছে করে। কারণ আমার হৃদয় বেদনায় জর্জরিত। আমার বোধশক্তি তিরোহিত। আমি হতবাক, আমি স্তম্ভিত। আমি আতঙ্কিত। এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাসে রাসুলের (সা.) চরম শত্রুরা যা কখনও কল্পনাও করেনি, সালমান রুশদির মতো সাম্রাজ্যবাদের গৃহপালিত লেখকও যে ভাষা ব্যবহার করতে সাহস পায়নি, এমনকি ধর্মান্ধ ক্রুসেডাররাও যে ভাষা ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ করেছে, তার চাইতেও নোংরা, জঘন্য, অশ্লীল, হিংস্র ও অসভ্য ভাষা ব্যবহার করেছে রাজীবসহ আরও কয়েকজন ব্লগার। যারা ব্লগার নামেরও কলঙ্ক। ডধত্ ডড়ষভ-এর মতো জিঘাংসা নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাসুলের পবিত্র নামের ওপর। আশ্চর্যের বিষয় এদের কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নয়, সবাই মুসলমান অথবা মুসলিম পরিবারের সন্তান। এদের কেউই এলিয়েন নয়, কোনো জন্তু-জানোয়ার নয়। এরাও মানুষ! কোনো না কোনো নারীর জঠরে এদের জন্ম।
এরা যদি মানুষ হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষ শব্দটি তার তাত্পর্য হারিয়ে ফেলেছে। এরা যদি নাস্তিক হয় তাহলেও বুঝতে হবে এরা ভণ্ড নাস্তিক। এরা নাস্তিক হওয়ারও অযোগ্য। কারণ নাস্তিক্যবাদও এক ধরনের বিশ্বাস। একটা বিশ্বাস কখনোই অন্য একটি বিশ্বাসকে আহত করে না, অপমান করে না। এ প্রসঙ্গে মনীষী আহমদ শরীফের (যিনি একজন খাঁটি নাস্তিক ছিলেন) উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না—‘নাস্তিক হওয়া সহজ নয়।...তাই প্রাচীন ও আধুনিক দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত নাস্তিকই ছিলেন সুজন, সুনাগরিক ও মনীষী।’ রাজীব এবং তার সহচররা তো এই কথার ধারে-কাছেরও কেউ নয়। ওরা তো বন্য বরাহের চাইতেও দাঁতাল এবং কুিসত। চ্যানি বলেছেন, যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারাই যুবক। যারা ধর্মে অবিশ্বাসী তারাই বৃদ্ধ। তাহলে এরা যুবকও নয়, বৃদ্ধও নয়, এরা কদর্য-কোনো প্রাণী। যাদের উদ্দেশ্য হলো দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনা। হানাহানি ডেকে আনা। রক্তপাত ডেকে আনা।
ধর্ম হলো মানুষের গভীরতম, নিবিড়তম এক বিশ্বাস। তার সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান। সেই জায়গায় যেমন অন্যের প্রবেশাধিকার নেই, তেমনি তাকে অসম্মান করার অধিকারও কারও নেই। এজন্যই রবার্ট বার্টন বলেছেন, ‘ধর্ম মানব মনীষা আর উপলব্ধির এক দুর্লভ কৃতিত্ব আর সম্পদ। ধর্মের কাছে মানুষ পায় আত্মজ্ঞান, অতীন্দ্রিয় জিজ্ঞাসার প্রেরণা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধার শান্তি ও সান্ত্বনা। ধর্ম মানুষকে দেখিয়েছে বিশ্বাস, ভক্তি, বিনয়, ক্ষমা, করুণা আর আত্মনিবেদনের পথ, দিয়েছে শৃঙ্খলা আর সংযত জীবনের দীক্ষা।’ সেই স্থানে ড্রাকুলার মতো, শয়তানের মতো, গোঁয়ারের মতো আঘাত করেছে সরকারের নিয়োজিত হাতে-গোনা কয়েকজন ব্লগার।
আসলে এরা ব্লগার নয়, ব্লগারের ছদ্মবেশ পরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী।
পৃথিবীর দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের রাসুলকে করেছে চরম অপমান এবং তা এমন একসময় যখন সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র, রক্তপিপাসু ইসরাইল এবং আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাস, ভীতি এবং আতঙ্ক। উদ্দেশ্য ইসলাম নির্মূল।
সঙ্গত কারণেই এইসব তথাকথিত ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এরা এদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছে সম্প্রীতি, সমঝোতা ও শান্তির বিরুদ্ধে। উস্কে দিতে চেয়েছে আগুন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে বাংলাদেশকে। আর এদের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে একটি ব্যর্থ, অযোগ্য, অপদার্থ সরকার ও তাদের পা-চাটা গণমাধ্যম। যারা হারিয়ে ফেলেছে পেশাদারি সততা। সরকারের মতোই এরাও সাইকোপ্যাথ। যারা অন্ধের মতো সবকিছুর মধ্যে জামায়াত-শিবির খুঁজে বেড়ায়। আর চেপে যাচ্ছে সত্যকে।
দুই
আমাদের নেতা তখন আতিকুর রহমান সালু। পূর্ব পাকিস্তান বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের তিনি তখন সাধারণ সম্পাদক। সালু ভাই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির স্থপতি। আর আমি বলছি ষাটের দশকের শেষ দিককার কথা। সুদূর ভূরুঙ্গামারী থেকে রংপুর এসেছি তার এক জনসভায় যোগ দিতে। ফেরার পথে জড়িয়ে গেলাম হাঙ্গামায়। তখন তো বাহন বলতে কেবল ট্রেন। সেই ট্রেনে আমাদের কামরায় উঠলো ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা প্রথম থেকেই মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে আজেবাজে ভাষায় আক্রমণ শুরু করে দিল। আর মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ তখন আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা। আমরা অনুরোধ করলাম বাজে কথা না বলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা অশ্লীল ভাষার ব্যবহার থেকে বিরত হলো না। শুরু হলো প্রতিআক্রমণ। তারপর যা হয়। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। হাতাহাতি থেকে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। ট্রেনের যাত্রীরা ভয়ে চিত্কার শুরু করে দিল। থেমে গেল ট্রেন। ছুটে এলো গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ। তারাও থামাতে পারে না। এর মধ্যে ছাত্রলীগের দুই-তিন জনের মাথা ফেটে গেল। আমাদেরও কেউ কেউ রক্তাক্ত।
রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল করার জন্য যদি এত বড় কাণ্ড ঘটতে পারে, তাহলে ধর্মকে অপমান করলে, নবী, অবতারদের অপমান করলে কী ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
শুধু মুসলমান বলে কথা নয়, হিন্দুদের দেবদেবী, খ্রিস্টানদের যিশু কিংবা বৌদ্ধদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেও তারা একই রকমভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে পারে। এই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, যত ক্রুসেড হয়েছে অন্য কোনোকিছু নিয়ে এত নয়। ভারতে এখনও দাঙ্গাহাঙ্গামা নৈমিত্তিক ব্যাপার। এজন্যই অন্য ধর্মের লোকদের গালমন্দ করার ব্যাপারে কোরআন শরীফে নিষেধাজ্ঞা আছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ করো না। তাহলে তারাও ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে।’ [সুরা আল-আনয়াম]।
বলা হয়েছে ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ [ধর্মের বিষয়ে জোর-জবরদস্তি নেই]। হাদিসে আছে রাসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করবে, তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, কিংবা তাকে সাধ্যাতিত পরিশ্রম করাবে, তার অমতে তার কিছু ছিনতাই করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার প্রতিপক্ষ হবো।’
ইসলাম বলে, ‘অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করবে না। যদি তর্কবিতর্ক করতেই হয়, তাহলে তা করো উত্তম পন্থায়।’
আমি পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চাই আমি কোনো ধর্মবেত্তা নই। ইসলামী চিন্তাবিদ নই। সেই অর্থে প্র্যাকটিসিং মুসলিমও নই। তারপরও ইসলামের বিশ্বজনীন বাণীর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ প্রগাঢ়। সেজন্যই পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি, ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি সম্মানবোধ লালন করি অন্তরে। বিশ্বাস করি কোনো ধর্মই বিদ্বেষ ও হানাহানি নয়, মানুষে মানুষে প্রেম ও শান্তিকেই দিয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব।
ব্লগার রাজীবের অন্যায় ও অন্যায্য কাজ এবং তার সহচরদের সহযোগিতা, বাংলাদেশের মানুষের মতো আমাকেও ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত করেছে। বিশেষ করে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তারা যা লিখেছে তা এককথায় ক্ষমাহীন। সেজন্যই দেশজুড়ে জ্বলে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। ধর্মপ্রাণ মানুষজন পথে নেমেছে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে নয়, তারা পথে নেমেছে অপমানের বিরুদ্ধে, তাদের দাবি একটাই—এই ঔদ্ধত্য অবশ্যই দেশ, জাতি, ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে, কল্যাণ ও মঙ্গলের স্বার্থে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সময় ক্ষমতাসীন আছে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার, যারা এই ধর্মবিদ্বেষীদের পক্ষ অবলম্বন করে ধর্মপ্রাণ মানুষদের শায়েস্তা করার জন্য নামিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ তাদের দলীয় ঠাঙ্গারেদের। হামলা মামলায় জেরবার করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি শাহবাগের চত্বরের জমায়েতকে সামনে নিয়ে বিরোধী গণমাধ্যম বিশেষ করে আমার দেশ ও তার সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভির বিরুদ্ধে একের পর এক ছাড়ছে রণহুঙ্কার। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে জটিল কুটিল আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র। নতুন করে দেয়া হয়েছে মামলা। তিনি নাকি উস্কানি দিচ্ছেন। মাহমুদুর রহমান তো খবর ছাপিয়েছেন মাত্র। যারা উস্কানিদাতা তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। কিন্তু উস্কানিদাতাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে এখন উল্টো অভিযোগ চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের ওপর। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই রকম বিষোদগার ১৯৭৫ সালের পর আর এদেশে দেখা যায়নি। এখন দেয়া হচ্ছে আল্টিমেটাম, গ্রেফতারের হুমকি। শাহবাগের নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগের ক্যাডারদের পাশাপাশি এখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরাও স্বমূর্তি ধারণ করে বকছেন আবোল-তাবোল।
সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললে যে কাউকে পেতে হচ্ছে কঠিন দণ্ড। ঘটছে চাকরিচ্যুতি। এখন বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়ে পড়ছে ফালতু বিষয়। আর মহানবী (সা.)কে অপমান করলে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করলে পাওয়া যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। মহানবীর গালমন্দকারীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী উপাধি দেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’। তড়িঘড়ি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাতকারীর বাসায়। জানান সহানুভূতি। আর যারা ধর্মের অপমানের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। তাদের হত্যা করা হচ্ছে। কুকুর ও সাপের মতো তাদের পেটানো হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসাগুলো।
আধিপত্যবাদের তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলোও সরকারের পাপিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে কোরাস। তারা সাংবাদিকতা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীদের মতো জুলুমকারীকে বানাচ্ছে বীর। আর নির্যাতিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে অপপ্রচার। তাদেরকেই করছে দোষারোপ। সরকার এবং এই গণমাধ্যম পরিস্থিতিকে শান্ত করার বদলে উল্টো অপরাধীদের উস্কে দিচ্ছে আরও সহিংস হওয়ার জন্য। ধর্ম এবং আদালত দুটোরই এখন লাঞ্ছনার শেষ নেই এদেশে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমার দেশ যে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে, তার প্রশংসা করার বদলে তারা এখন পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর তাদের কর্কশ কণ্ঠকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
সঙ্গত কারণেই যে কারও পক্ষেই এই ধারণায় উপনীত হওয়া সহজ যে, সরকার ইসলাম ধর্ম এবং বিরোধী গণমাধ্যমকে পিষে মারার জন্য অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরকে দমন করার উসিলায় তারা আসলে দমন করতে চাচ্ছে সব বিরোধিতাকে। জামায়াত-শিবির দমন হলো তাদের উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়া। দেশকে ভেতর থেকে অকার্যকর করে দেয়া। সে জন্যই তাদের কাছে এ বিষয় স্পষ্ট যে শাহবাগ চত্বরের জমায়েত হচ্ছে তাদেরই ইচ্ছায়। তাদেরই নির্দেশে। সরকারি নানামাত্রিক ষড়যন্ত্রেরই একটি পর্যায় হলো শাহবাগ। সেজন্যই আজ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে কুত্সা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বলা হচ্ছে রাজাকার। শাহবাগ চত্বরের এমরান জাতীয় দলীয় লোকদের হম্বিতম্বি, নাসিরউদ্দিন ইউসুফদের আস্ফাালন ছাড়িয়ে গেছে মাত্রা। আর প্যান্ট খুলে গেছে সরকারের। সরকার ও শাহবাগ এখন একাকার।
সরকার ব্লগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করে তাদের লেলিয়ে দিয়েছে দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সব ধর্মবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে ডেকে আনছে সহিংসতা। ডেকে আনছে রক্তপাত।
সেজন্যই তাদের দলবাজ বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় হয়েছে অবতীর্ণ। ফলে নিজেদের বেলায় গণতন্ত্র, ১৭ দিন ধরে শাহবাগ দখল করে রাখলেও তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ একদিন মিছিল করলেই তা কবিরা গুনাহ হয়ে যায়। চমত্কার বাকশালী গণতন্ত্র!
তিন
ব্লগার রাজীব কিংবা তার দুষ্কর্মের দোসরদের দোষ দিয়ে সস্তা হাততালি পেতে চাই না আমি। দোষ তো বীজের। দোষ তো পরিবারের। দোষ তো বাবা-মা’র। দোষ তো সমাজের। দোষ রাষ্ট্রের। দোষ রাজনীতির। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। দোষ আমাদের পরিবেশের।
আমরা তো আমাদের সন্তানদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। যথার্থ শিক্ষা দেইনি। ব্যর্থ পিতামাতার ব্যর্থ শিক্ষা এবং ব্যর্থ রাজনীতির জরায়ু থেকে তো ভালো মানুষ জন্মানোর কোনো পথ নেই। ভালো মানুষ জন্মাতে পারে না। পারে না বলেই জন্ম হচ্ছে রাজীবের মতো, বাপ্পাদিত্যের মতো বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন সন্তানদের।
সেজন্যই অনুরোধ করি, আসুন জাতীয় জীবনের এই চরম দুর্যোগের দিনে, আমরা আমাদের সন্তানদের আবার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেই। ফিরিয়ে আনি হারিয়ে যাওয়া নীতি ও নৈতিক শিক্ষায়। তাদের স্বর্ণগর্ভ অতীত সম্পর্কে জ্ঞাত করাই। বর্তমানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করি। নিশ্চিত করি অনাগত ভবিষ্যত্। রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করি দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন দেশপ্রেম বর্জিত অসত্, ভণ্ড, প্রতারক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের। তাদেরকেও মাও সেতুঙের মতো, স্টালিনের মতো সংশোধনাগারে পাঠিয়ে আবার মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেই। জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরের মতো এই দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সরকারের লোকজনদেরও ধরে ধরে শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেখতে বাধ্য করি খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছায়াছবি।
কেবল তাহলেই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে শ্রেয়বোধগুলো। ফিরে আসবে মহত্ত্ব। নইলে নব্য বাকশালীদের জিঘাংসা গিলে খাবে আমাদের সব অর্জন। গিলে খাবে দেশটাকে।
a_hyesikder@yahoo.com