রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১২

যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এখন থেকে একশ’ বছর পরে, অথবা এক হাজার বছর পরে, কিংবা আরও পরে, যদি তখনও মানুষ থাকে পৃথিবীতে, কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে আমাদের সময় ও জীবন নিয়ে—ন্যায়, নীতি, সততা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, বিচার ও প্রেমহীন একটি সময়ে ওই লোকগুলো বেঁচে ছিল কীভাবে? তাদের উদ্দেশে এই হানাহানি, বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসম্প্রীতি ও অবিবেচনায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সময়ের পত্রহীন, পুষ্পহীন, বাষ্পহীন, অনুতাপহীন প্রান্তর থেকে বলে রাখছি, যদি এই লেখা তাদের কাছে পৌঁছে আমাদের অনেক কিছু ছিল না, এ কথা সত্য। বন্য শুয়োরের কাদা ঘাঁটার মতো সীমিত, সংকীর্ণ ও নোংরা হয়ে পড়েছিল আমাদের জীবন। তারপরও আমরা বেঁচেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, আনন্দ ও বেদনার নুনপানিতে ভেসেছিলাম শুধু একটি কারণে—আমাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন। কবি আল মাহমুদ ছিলেন। মাত্র একজন কবি ছিলেন বলেই আমাদের প্রতিদিনের রুমালগুলো সূচিকর্মহীন ছিল না।
আজকের এই দিনে, এখনও যাদের মানুষ হিসাবে ধরে নেয়া যায়, এখনও যারা সাদা আর কালোর পার্থক্য কিছুটা হলেও ধরতে পারেন, তাদের বলি, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই আমরা আছি। যে কয়টি সংবাদ আমাদের প্রতিটি সূর্যোদয়কে সম্ভাবনাময় করে তোলে তার অন্যতম আল মাহমুদের বিচরণশীলতা। তাঁর সচলতা ও সক্ষমতা। তার বহমান সৃষ্টিশীলতা। তিনি আছেন বলেই আমাদের দিনগুলো কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে যায় না। ডুবতে ডুবতেও ডুবে যায় না, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শিশুর গালে চুমু খায়। আর রাতগুলো কালো হতে হতেও পুরো কালো হয় না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস তার নীরবতাকে চুরমার করলেও সে কিছুটা উদ্বেগহীনতার মধ্যে আরাম খোঁজে। তারপর স্বপ্ন দেখে ডাবের মতো চাঁদ, ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
দুই
বাংলা সাহিত্যে মীরদের প্রথম আবির্ভাব ১৮৪৭ সালে মীর মশাররফ হোসেনের মধ্য দিয়ে। প্রথম এবং অসাধারণ ছিলেন সেই মীর। ১৮৮৫-তে যদি তার বহু বিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ নাও প্রকাশিত হতো তাহলেও তাকে নিয়ে আজ আমরা যা বলছি, তার ব্যত্যয় ঘটত না। যে কোনো বিচারেই তিনি আমাদের নবজাগরণের অগ্রদূত। এই মীরের জন্মের ৮৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে দেশের আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় মীরের জন্ম। এই মীর আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ।
প্রথম মীরের সঙ্গে দ্বিতীয় মীরের মিল ও অমিল অনেক। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের পর আর যদি কিছু নাও লিখতেন, তাহলেও আল মাহমুদ আল মাহমুদই থাকতেন।
দুই মীরের বাড়ি দুই নদীর তীরে। একজন গড়াই কূলের। অন্যজন তিতাস তীরের। একজনের বিষাদ সিন্ধু এবং অন্যের সোনালী কাবিন—সমান মাত্রা ও শব্দবন্ধের। ‘স’ ও ‘ব’ তাদের মধ্যে সাধারণ। তবে অমিলটা হলো একজন মীর লিখতেন নামের আগে, অন্যজন মীর উপাধি কখনোই ব্যবহার করেননি।
কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য এই দুই মীরকে নিয়ে তার বিখ্যাত ‘মীর পরিবার’ গল্প গ্রন্থ লেখেননি। তবুও আহমদ মীর, মোস্তফা মীর, আশরাফ মীর এঁরা ‘মীর’ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন।
তিন
আসলেই ‘মীর’ বর্জনকারী আল মাহমুদ আমাদের জসীমউদ্দীন। আমাদের নকশিকাঁথার মাঠ। আমাদের সোজন বাদিয়ার ঘাট। আমাদের বালুচর।
তিনি আমাদের জীবননানন্দ। আমাদের মহা পৃথিবী। আমাদের সাতটি তারার তিমির।
তিনি নজরুলের সকালবেলার পাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাত সঙ্গীত।
তিনি আছেন আমাদের জাগরণে। আমাদের স্বপ্নে। আমাদের মনে। আমাদের দেহে। আমাদের তিনশত চল্লিশ নদীর বাঁকে বাঁকে। তিনি আছেন আমাদের পানিউড়ি পাখির ছতরে। তিনি আছেন ওপাড়ার সুন্দরী রোজেনার সর্ব অঙ্গের ঢেউয়ে। মকতবের মেয়ে আয়শা আখতারের খোলা চুলে। তিনি আছেন আমাদের ইসবগুলের দানার মতো জলভরা চোখে। আছেন শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশের চিকচিকে বালুতে।
আল মাহমুদ আছেন আমাদের সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে। পাহাড়পুরে। তিতাসে। ড্রেজার বালেশ্বরে। আছেন মুক্তিযুদ্ধে। আছেন বিরামপুরে। আছেন আমাদের খড়ের গম্বুজে। আমাদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। স্বপ্নের সানু দেশে। আল মাহমুদ আছেন আমাদের ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে। তিনি আছেন নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটিতে। তিনি আছেন ‘ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান’-এ। আছেন আমাদের চিন্তায়। চেতনায়। আমাদের সৃষ্টিশীলতায়।
চার
আল মাহমুদ আছেন বলেই এখনও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আল মাহমুদ আছেন বলেই আমরা এখনও হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি। আল মাহমুদ আছেন বলেই ড. ইউনূস বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মৌলিক মৃত্তিকা হয়ে ওঠেন। উঁচুতে তুলে ধরেন দেশের সম্মান ও মর্যাদা। আল মাহমুদ আছেন বলেই মুসা ইব্রাহীম, এমএ মুহিত, নিশাত আর ওয়াসফিয়া এভারেস্টের ওপর পা রাখেন। আর সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার।
নোংরা, সংকীর্ণ, মূর্খ ও স্বার্থপর কিছু প্রাণীকে এখনও যে এদেশের মানুষ কবি বলে সম্মান করে, সে তো শুধু এই কারণে যে আল মাহমুদ এখনও বেঁচে আছেন।
পাঁচ
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যে কথাগুলো লিখলাম তা পড়ে অনেকের গা জ্বলে যাবে। শরীর চুলকাবে। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মতো যারা একটু বেশি শয়তান, তারা বলবে আবেগের দোকানদারি করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে।
তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি থাকবে। আমরা তাদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দেব। তারপর বলব, তোমাদের জীবন হলো নর্দমার ধারে। হাজারীবাগের ট্যানারির পচা পানিতে হয় তোমাদের অবগাহন। তোমাদের জীবন দুর্নীতি নিয়ে। তোমাদের সকাল হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। দিন কাটে দুর্নীতি করে করে। রাতে ঘুমাও দুর্নীতির বিছানায়। স্বপ্নও দেখো দুর্নীতি নিয়ে। সাহিত্য তোমাদের মতো ‘হারামখোর’দের বিষয় নয়। আর কবিতা, সে তোমাদের সইবে না। ‘সুসংবদ্ধ কথামালা’ নিয়ে স্বপ্নের সওদাগরি যারা করে, তাদের ভাষা বোঝার জন্য নতুন চরের মতো হৃিপণ্ড চাই।
স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই আমার চোখের চারদিকে তৈরি হচ্ছে ঘোর। এক ধরনের মায়াবী পর্দা উঠছে দুলে। কাজলের ছোঁয়ায় জেগে উঠছে প্রাণ। ভোরের মোরগের ডাক কানে আসছে। মোহনা কাছাকাছি বলেই বোধ করি শুনছি নোনা দরিয়ার ডাক। প্রিয় পাঠক, আসুন সেই সম্ভাবনা আর স্বপ্নের কথা তেলাওয়াত করি।
ছয়
জীবদ্দশায় আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কিনা আমি জানি না। মরণোত্তর নোবেল দেয়ার বিধানও চালু হয়নি। যা হোক, পেলে ভালো। না পেলে না পাবেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তো আর আল মাহমুদ কবিতা লেখেননি। এখন নোবেল পেলে আল মাহমুদের আর কী যায় আসবে। তবে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। না পেলেও বাংলাভাষীরা আল মাহমুদ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে তাদের ঘর ও অন্তর।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে তিনি বিশ্ব কবি সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাংলাদেশ ও এশিয়ার সীমা তো তিনি ছাড়িয়েছেন সেই ১৯৭৩-এ সোনালি কাবিনের যুগেই। এখন দরকার বাদবাকি বিশ্বের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আল মাহমুদ নেবেন কেন। নেব আপনি, আমি, আমরা।
তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের দেশে। নোবেল লরিয়েটের জীবনকে অতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের জুড়ি মেলা ভার। যেন নোবেল পাওয়াটা এক ধরনের ক্রিমিনাল অফেন্স। এই জন্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক জিল্লতি। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি পুরস্কারের অপমান করেছেন, এমন কথা বলার লোক সেদিনের কলকাতায় অভাব ছিল না। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গালাগাল করার ক্ষেত্রে আমাদের যদুমধুরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। অমর্ত্য সেন ও প্রফেসর সালামের মতো যারা একটু অপ্রভাবশালী শুধু তারাই কিছুটা রেহাই পেয়েছেন।
যা হোক, সম্ভাবনার শেষ নেই। সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। তাছাড়া সব ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হবে, এমন কোনো কথাও নেই। তো যদি আল মাহমুদ সৌভাগ্যক্রমে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান তাহলে কী হবে? এই কী হবের কোনো শেষ নেই। তার চেয়ে আমরা বরং ‘আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি-উত্তর প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে কিছু অগ্রিম বাক্যাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখি। এই সব কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া সত্য হোক, তা আমি চাই না। মিথ্যা হলে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব।
প্রতিক্রিয়া ১ : সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ সামাদ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, রবীন্দ্র গোপ, তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদ, মিনা ফারাহ, মাসুদা ভাট্টি, আসলাম সানি, লুত্ফর রহমান রিটনসহ আরও অনেকে নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখবেন—মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে থাকা একজন মৌলবাদী কবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে মূলত বাংলাদেশকেই অপমান করা হয়েছে। অবিলম্বে এই পুরস্কার প্রত্যাহার করা হোক।
প্রতিক্রিয়া ২ : কবি মোহন রায়হান, নাসির আহমদ বলবেন—নোবেল পুরস্কার পান আর যাই পান, তিনি স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল ছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ৩ : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলবেন—এর ফলে দেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পাবে। তাদেরই আশকারা দেয়া হলো। আমরা জানি কীভাবে নোবেল দেয়া হয়। আগে মদ খেতে হতো। এখন শরাব খেলেই পাওয়া যায়।
প্রতিক্রিয়া ৪ : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলবেন—নোবেল পুরস্কার পেলেই কেউ একজন কবি হয়ে যায় না। কবি হতে হলে রবীন্দ্রনাথের মতো ৮০ বছর বাঁচতে হয়। সংবিধানকে বুঝতে হয়।
প্রতিক্রিয়া ৫ : আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা আসবে তার কলামে—‘হাসান হাফিজুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, শামসুর রাহমান মরার আগে আমাকে বলে গেছেন, তাদের মৃত্যুর ২০ বছর পর যেন আমি বলি ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদের লেখা নয়। এটার একটা অংশ লিখেছিলেন শহীদ হুমায়ুন আজাদ এবং অন্য অংশ লিখেছিলেন আর একজন মরহুম এতাজ ইউসুফী।
প্রতিক্রিয়া ৬ : আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলবেন—নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঢুকে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়া ৭ : মতিয়া চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানাবেন—আল মাহমুদ তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা নির্মলেন্দু গুণের ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। সে আবার কিসের কবি।
প্রতিক্রিয়া ৮ : মাহবুব উল আলম হানিফের কথা—একজন মুক্তিযোদ্ধা যত বড় ত্যাগই স্বীকার করেন, তিনি যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাই হতে পারেন না, যদি না তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন। একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকই যেমন সঠিক মুক্তিযোদ্ধা, তেমন একজন কবি তখনই যথার্থ কবি এবং নোবেল পাওয়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন, যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন।
প্রতিক্রিয়া ৯ : সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলবেন—দেশে এত ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’র সৈনিক থাকতে কেন আল মাহমুদের মতো লোকেরা নোবেল পায়, তা উদ্বেগের বিষয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দিকটি আমার পুলিশ ও র্যাব খতিয়ে দেখছে।
প্রতিক্রিয়া ১০ : ড. সনজিদা খাতুন, শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুন বলবেন—তিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধ চাননি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ১১ : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং ড. আবুল বারাকাত বলবেন—আল মাহমুদের নোবেল প্রাপ্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোটেও বাড়বে না, বাড়বে না জিডিপি। তা হলে এ পুরস্কার ধুয়ে কি পানি খাব?
প্রতিক্রিয়া ১২ : ‘তিনি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাসাসের সভাপতি ছিলেন। সে সময় তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করেছিলেন কিনা তা দেখার জন্য মহামান্য আদালতের কাছে রুলনিশি জারির আবেদন করছি।’ এই আবেদনকারী হয়তো হবেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
প্রতিক্রিয়া ১৩ : ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, কিছু সাহিত্য সংঘের মাধ্যমে হয়তো গড়ে উঠবে একটি ‘আল মাহমুদের নোবেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সামনে টানা কয়েকদিন মানববন্ধন করবে। সেখানে বক্তারা বলবেন—দেশে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। ড. ইউনূসের পর এবার যারা কবি আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন তারা দেশদ্রোহী। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’-এর ভাড়াটে চর। এদের আক্কেলদাঁত উপড়ে ফেলা আজ জাতীয় কর্তব্য। দাঁত ওঠাতে সমস্যা থাকলে প্রত্যেকের একটি করে ঠ্যাং ভেঙে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।
প্রতিক্রিয়া ১৪ : মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলবেন—আই অ্যাম একদম ফেড আপ। অল আর রাবিশ। নোবেল কমিটি এখন দুষ্টু কমিটি, ওটা একটা ফটকা বাজার।
প্রতিক্রিয়া ১৫ : হাসানুল হক ইনু বলবেন—আল মাহমুদের সঙ্গে মৌলবাদী মানবতাবিরোধীদের সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাকে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলা সাহিত্য থেকে মাইনাস করতে হবে। তিনি যদি নিজে নিজে মাইনাস না হন, তাহলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে আমরাই তাকে মাইনাস করে দেব। কাউকে মাইনাস করার ক্ষেত্রে আমাদের যে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তার পুরোটাই এক্ষেত্রে প্রয়োগ করব আমরা।
প্রতিক্রিয়া ১৬ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হয়তো হাসতে হাসতে বলবেন—আল মাহমুদ নোবেল পেয়েছে তো কী হয়েছে? আগে পেয়েছিলেন একজন সুদখোর এবং এবার পেয়েছেন একজন ধর্মখোর।
প্রতিক্রিয়া ১৭ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলবেন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নোবেল পুরস্কার শোভা পাবে। আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার ভেতর দিয়ে সেই স্বপ্নই কিছুটা পূরণ হলো। এই নোবেল প্রাপ্তি দেশরত্ন বিশ্বনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারেরই একটি সাফল্য। আমরা এর আগে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বিজয় অর্জন করেছিলাম। তারপর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি সমুদ্রবিজয়ে। এই চ্যাম্পিয়ন লাভের ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রতিক্রিয়া ১৮ : কবি আল মাহমুদ যেসব বাড়িতে গেছেন, যাদের সঙ্গে মিশেছেন, তারা তড়িঘড়ি আল মাহমুদের সঙ্গে তোলা ছবি ড্রইং রুম ও অফিস কক্ষে বাঁধাই করে রাখবেন।
আর যেসব কবি-লেখক আল মাহমুদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন, তারা সেইসব সার্টিফিকেট ও ছবি নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় বিপুল বেগে নাজিল হবেন।
সাত
এই ডামাডোলের মধ্যে কষ্টে কঁকিয়ে উঠবে দেশের আত্মা। সাধারণ মানুষ আহত হবেন, হবেন ক্ষুব্ধ। যারা সত্যিকার অর্থে সাহিত্যনিষ্ঠ, যারা সাহিত্যকে সাহিত্য দিয়েই বিচার করেন, তারা হবেন হতবাক। হবেন মহা বিরক্ত। কেউ কেউ হয়তো স্মরণ করবেন জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর কথা। তারপর ভেবে কূল পাবেন না, আমাদের এরা কোন ফার্মের বাসিন্দা।
শুধু কবি আল মাহমুদ থাকবেন নির্বিকার। কণ্ঠে হয়তো বড় জোর বাজতে পারে নিজেরই কয়েকটি চরণ—
‘বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাত্ পাল্টে গেল। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃণ্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনাজুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার?’
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন : গৌরবের দিনলিপি : বই নয় আর্কাইভস



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক.
কথাশিল্পী আবু রুশদের একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ২২ জুন ১৯৯০-এ দৈনিক বাংলায় (দৈনিক বাংলা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যা করেছেন। সেজন্য বলতে হবে অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত সেই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আরেকটি জিনিস ঘটে, হয়তো একজন লেখক সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকটি উচ্ছ্বসিত ধরনের আলোচনা বা নিবন্ধ বের হয়ে গেল। অথচ সেই লেখক শক্তিশালী কেউ নয়। তাই—পাঠকরা এ ধরনের অতি উত্সাহী আলোচনা দেখে সেই লেখককে যখন যাচাই করতে যায়, দেখে বেশ ফাঁক রয়ে গেছে। তখন সামগ্রিকভাবে আমাদের লেখকদের সম্পর্কে নিরুত্সাহী হয়ে পড়ে তারা। হতাশ হয়ে যায়।’
এই অভিজ্ঞতাটা আমার ঝুলিতে আছে। অনেক অতি প্রগলভ, উচ্ছ্বাসের ফেনায় ভেসে যাওয়া গ্রন্থালোচনা পাঠ করে মূল বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়েছি। মনে হয়েছে গ্রন্থালোচক আমাকে প্রতারিত করেছেন।
দলবাজি, গ্রুপবাজি, অশিক্ষা ও অপুষ্টির শিকার আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ঘাড়ে চেপে বসেছে এক ধরনের প্যারাসাইট। এই পরান্নভোগীরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চায় চোখ। স্রেফ ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এদের বিচারবুদ্ধি হয় বিলুপ্ত। বড় হয়ে ওঠে উচ্চাভিলাষ। এজন্য কারণে-অকারণে নিজেদের এই নোংরা টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত লেখক যত জগামগাই হোক, কল্কি পেয়ে যান। যদুর চরকায় তেল দেয় জব্বার, জব্বারের চরকায় তেল দেয় মধু। মধু আবার যদুকে বড় করে তোলে। এই চক্রে এখন পচা পাগাড়ে আবদ্ধ শুয়োরের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য।
এই চক্র নিজেদের লেখক ও লেখকের বইকে নিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। আর তাদের হিসাবের বাইরের লেখক ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে থাকে নিঃশব্দ। এখন আবার এই প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে চটকদার বিজ্ঞাপন। নতুন আরেকটি ফ্যাশন এখন আমাদের সাহিত্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টাটাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বইয়ের মার্কিং করে এ বছরের সেরা ১০ বই, বছরের সেরা ৭ বই ইত্যাদি নামে। এসব ভাগ্যবান বই বা লেখক তাই বলে বাইরের কেউ নয়, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার খোঁয়াড়েই লালিত-পালিত বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন বাচাল লেখক।
কখনও কখনও বড় কিংবা আলোচিত হওয়ার জন্য লেখকদের মধ্যেও কাজ করে নানা ধান্ধাবাজি। এই ধান্ধাবাজির একদিকে থাকে চালাকি, শ্রমবিমুখতা ও তাস্কর্যবৃত্তি। অন্যদিকে থাকে ক্ষমতাসীনদের পা চেটে, তাদের স্তাবক বা নিশানবরদার সেজে ইহলৌকিক তরক্কি অর্জন।
এই জাতীয় লেখক দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছেন আমাদের দুই জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান। একই বই শত শত নামে বেরিয়েছে এ দুজনের জন্য।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক তোলপাড় করা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’র স্রষ্টা ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ‘কত ছবি কত গান’। সেই ইলিয়াস ভাই ’৭১-এর পরে মুজিব বন্দনার সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন ‘মুজিববাদ’ বই দিয়ে। ইলিয়াসের পাঠকরা এতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। আর বিরক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারা। কারণ তাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের বাড়া ভাত যেন কেউ কেড়ে দিতে চাচ্ছে। মুজিববাদের জন্যই ডুবলেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
ড. মাযহারুল ইসলামের বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পড়ে স্বয়ং শেখ মুজিব নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বইটির তথ্যগত ভ্রান্তি এবং বল্গাহারা বিশেষণ প্রয়োগের তাণ্ডব ধরিয়ে দিলে চুপসে যান গ্রন্থকার।
জিয়াউর রহমানকে নিয়েও একই কাণ্ড চলছে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের দ্বারা। এখানে আছে নানা সাইজ ও আয়তনের মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। বিভিন্ন লেখকের লেখা কালেকশন করে এক একজন এক একটা বই বের করেছেন। নিজের নাম ফাটানোর জন্য আছে নানা কায়দা। আবার এই একটি সংগ্রহ থেকেই লেখা নিয়ে আরও চল্লিশজন চল্লিশ নামে বের করেছেন বই। এর কোনো কোনোটির ওজন পাঁচ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নির্যাস নেই পাঁচ ফোঁটাও।
দুই.
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিরচিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনয়িন : গৌরবের দিনলিপি’। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন অ্যাডর্নেরই স্বত্বাধিকারী বন্ধুবর সৈয়দ জাকির হোসাইন। কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য এ ধরনের বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণ গড়পড়তা সাইজ নয়, রয়াল সাইজের এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৭৪। ওজন আনুমানিক ৩ কেজিরও বেশি। বৃদ্ধ এবং শিশুদের পক্ষে এ ধরনের বিশাল গ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, নাড়াচাড়া করাও দুঃসাধ্য।
যে কেউ এরকম জলহস্তির মতো বিরাট কলেবরের বই দেখে সত্যি সত্যি ভিরমি খেতে পারেন।
কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই যেহেতু ঘর পোড়া গরু, সেহেতু ভয় না পেয়ে উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করলাম। যাকে বলে আগাগোড়া স্কানিং করা, সে রকম পাঠ সমাপ্ত করতে মাসখানিক লাগার কথা। আমি বইটি ঘাঁটার (পড়ার জন্য নয়) জন্য সময় নিয়েছি মাত্র দুদিন। সে জন্য এ লেখাকে পাঠ-পরবর্তী নিবেদিত কোনো প্রবন্ধ হিসেবে না দেখে একটা দ্রুতরেখ মানচিত্র বলে ধরে নিলেই বাধিত হবো।
তিন.
ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘ইতিহাস এমনি একটি বিষয়, যা কখনও ঘটেনি এবং এমন লোকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, যে কখনও সেখানে ছিল না।’ প্রথমেই বলে নিই, এ বই সে রকম কোনো ইতিহাসবিদের রচনা নয়। এ বইয়ের লেখক মাহফুজউল্লাহ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক। কখনও তিনি নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা, কখনওবা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে আসা সচেতন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী, কখনওবা নেতা। সঙ্গত কারণেই ছাত্র ইউনিয়নের বিচারে তিনি ইতিহাস-মানুষ। ফলে অন্য দশটি তথাকথিত ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থকার ও গ্রন্থের ফারাক সুস্পষ্ট, দূরত্বও অনেকখানি। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য মানুষের মতো ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান’-এর মতো রুচিহীন কাজ এ গ্রন্থে কোথাও করেননি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনার স্তূপ তিনি খাড়া করেননি। অথচ এর সুযোগ ছিল। এই যে মাত্রাবোধ ও কাণ্ডজ্ঞান, সে জন্যই মাহফুজ উল্লাহ তার এই গ্রন্থের জন্য নন্দিত হবেন। পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখার জন্য এ বই যেমন পাবে পাঠকপ্রিয়তা, তেমনি অর্জন করবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা। এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ জোগাবে উপকরণ ও অনুপ্রেরণা। সে বিচারে এ বই জাতীয় ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি মাহফুজ উল্লাহর এই সময়োপযোগী প্রকাশনাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঠিক গ্রন্থ নয়, এ হলো একটা আর্কাইভস। একটি বিশাল আর্কাইভসের অক্ষরবন্দি রূপ। এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনুধাবনের নানা জিনিসপত্র। কেবল যেন পাঠের জন্য নয়, এ বই রচিত হয়েছে বিচরণের জন্য। উদ্যানের মধ্যে যেমন আমরা হেঁটে বেড়াই, এগাছ-ওগাছের কাছে যাই, এফুল-ওফুলের গন্ধ নেই, বর্ণ দেখে চমত্কৃত হই, কখনও হই বিচলিত—এ হলো সে রকম একটি আয়োজন।
আবার আমাদের ইতিহাসের অনেক হারিয়ে যাওয়া ভূভাগ, বিলুপ্ত অনেক অলিগলি, অনেক মানুষের অপরিসীম ত্যাগের কাহিনী পাঠক এর মধ্যে পাবেন। পাবেন একটি জাতির উত্থান এবং কিছু মানুষের পতনের বেদনাহত সূত্র। এজন্য এ বই আমাদের নিজেদের দেখার আয়নাও বটে। হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। এই পাঠে আমরা বিস্মিত হই, শিহরিত হই, ব্যথিত হই। কিন্তু আয়না থাকে নির্বিকার। এই নির্বিকারত্বই এ গ্রন্থকে মানোত্তীর্ণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি গ্রন্থ বিচারে বসি আমরা, তাহলে যে কেউ স্বীকার করবেন এই গ্রন্থ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশেরও ইতিহাস। এ গ্রন্থ শুধু ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি নয়, জাতীয় গৌরবেরও দিনলিপি।
চার.
বইয়ের শুরুতেই সবিনয় নিবেদনে লেখক বলেছেন, ‘আট বছরের পরিশ্রমের ফসল যে বইটি এখন হাতে নিয়েছেন তা প্রথাসিদ্ধ কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাস রচনার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের ভাণ্ডার।’ আসলেই এ গ্রন্থ একটা উপাত্তের ভাণ্ডার। ১২৭৪ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এ বই ধারণ করেছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৯ বছর।
ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই চারটি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সংগঠনটির জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাবান মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হন। এ ছাত্ররাই কর্মজীবনে দিয়েছেন প্রভূত সাফল্যের পরিচয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যে সময়সীমার কথা নিয়ে এ গ্রন্থ, সে সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ছাত্র ইউনিয়নই ছিল সবচেয়ে প্রাগ্রসর সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সদস্যদের দিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। করেছিল গভীরভাবে আত্মপ্রত্যয়ী। দিয়েছিল গৌরবময় জীবনের সন্ধান। যে গৌরবের সৌরভ আমাদের মতো অভাজনের গায়ে এখনও লেগে আছে।
মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ১৯টি পরিশিষ্টে সৃষ্টি হয়েছে এই বই। প্রতিটি অধ্যায় চিহ্নিত হয়েছে এক-একটি বছরের নামে। এই অধ্যায়গুলোর শুরুতেই আছে মূল বিষয়ের ওপর লেখকের কিঞ্চিত্ আলোকপাত। এরপর আছে ঘটনা প্রবাহ, যা গড়ে উঠেছে কেবল সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কাটিং নিয়ে। তারপর সংযুক্ত হয়েছে তথ্য নির্দেশ, যা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১৮টি অধ্যায়।
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর আলোকপাত, যা লেখকের নিজের লেখা, খুবই সংক্ষিপ্ত, একই সঙ্গে সংযমী ও পরিমিত। বাচালতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি মাহফুজ উল্লাহ।
পরিশিষ্টের ১৯টি অধ্যায় আসলে ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্টস, যা ইতিহাস গবেষকদের জন্য খুলে দেবে এক শস্যভারানত দিগন্ত।
আরও দিকের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আত্মবিশ্বাসহীন লেখককুলের অনেকেই বইয়ের ‘দাম’ বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট কেউকেটাদের দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে তার বাণিজ্যিক ব্যবহার। মাহফুজ উল্লাহ এই কদর্য কাজটি করেননি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই, এই ফাঁকে একটা ধন্যবাদ কি আপনাকে দেব?
আর একটা প্রশ্ন, বর্তমানকার অন্তঃসারশূন্য, দলবাজ ছাত্র সংগঠনগুলো এই বই থেকে কি কিছু শিক্ষা নেবে?
পাঁচ.
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন মাঝেমধ্যেই ভারি ভারি কিতাব প্রকাশ করে। সেগুলো কতটুকু খাদ্য আর অখাদ্য তা বলতে পারবো না। কিন্তু সেসব দেখে চোখ জুড়িয়েছে। বিশেষ করে আনোয়ার দিল অ্যান্ড আফিয়া দিল প্রণীত ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ সম্পাদিত ‘মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ : বাংলাভাষা স্মারক’-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ড. মাহবুব উল্লাহর গ্রন্থটি যখন বের হয় তার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে আমি অষ্টপ্রহর জড়িত। কিন্তু ভুলেও তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তিনি আমার মতো অনেক আমজনতার কাছে পুরো বিষয়টি চেপে রাখেন।
হয়তো তিনি আমাদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রকাশের পর ১০ কেজি ওজনের ঢাউস বইটি তিনি যখন আমার হাতে দেন, আমি আঁেক উঠি এবং হতবাক হই। আরও হতবাক হই, দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তার মোটামুটি জীবনপঞ্জি আছে বইটিতে। কিন্তু তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী—তার উল্লেখ নেই। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের হাতে এমনটা হয়েছে হয়তো তথ্য সংকটের কারণে। তো এই হতবাক দশা এখনও কাটেনি বলে মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের শত গালাগাল শুনেও বইটি নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা হয়ে ওঠেনি।
শেষ করার আগে মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ। কারণ তিনি জানেন ‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ সেজন্যই সেই নারী, তার গৃহের জিম্মাদার দিনারজাদী বেগমকে তিনি ভোলেননি। তার সবিনয় নিবেদন শেষ হয় তার নাতি-নাতনীদের জন্য আশাবাদে—‘আমার তিন নবীন প্রজন্ম আরমান রাকিন হক, দিয়ান জাকারিয়া ও জাহরান হাবীব যদি বড় হয়ে আমার যৌবনে লালিত বিশ্বাসকে ধারণ করে, তাহলে এই বই লেখা সার্থক হবে।’
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ যদি এই বই পাঠ করে উপকৃত হয়, উজ্জীবিত হয়, বাংলাদেশের দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে আসে—তাহলেই হলো।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

ভিলেন সিরাজদৌলা হিরো প্রণব মুখোপাধ্যায়


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

‘এলাম দেখলাম জয় করলাম’ বলে যে কথাটি বিখ্যাতদের বেলায় প্রচলিত, সে কথাটি আরও একবার সত্য হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’র বেলায়। এই নাটকটি প্রথমবার কলকাতার মঞ্চে আসে ১৯৩৮ সালের ২৯ জুন। অর্থাত্ পলাশী বিপর্যয়ের ১৮১তম বার্ষিকীর ৬ দিন পর এবং সিরাজের শাহাদাতবার্ষিকীর ৪ দিন আগে। মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকটি অর্জন করে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। পরবর্তীকালে মূলত এই নাটকের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’। শচীন বাবুর নাটক জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই নাটকটি আগাগোড়া সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন নজরুল। নাটকে ব্যবহৃত ৬টি গান, ‘আমি আলোর শিখা,’ ‘ম্যায় প্রেম নগরকো জাউঙ্গি’, ‘কেন প্রেম যমুনা আজি’, ‘পথ হারা পাখি’, ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’ ও ‘পলাশী হায় পলাশী’ নজরুলের লেখা। এই নাটকের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন নজরুল।
মঞ্চের পাশাপাশি ১৯৩৯ সালের ২৪ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে একটানা ২ ঘণ্টা এই নাটক প্রচারিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্র থেকে। সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী। আলেয়ার সংলাপ দিয়েছিলেন ঊষাবতী। গান গেয়েছিলেন হরিমতি। অবশ্য মঞ্চে কণ্ঠ দিতেন নীহারবালা। রেডিওতে এ নাটক পরিচালনা করেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।
এর পরপরই এইচএমভি কোম্পানি থেকে এই নাটকের রেকর্ড বের হয়। রেকর্ডে আলেয়ার গানে কণ্ঠ দেন পারুল বালা ঘোষ। ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন মৃণাল কান্তি ঘোষ।
নাটকের পাড়া অতিক্রম করে এই সিরাজদৌলা অচিরেই সগৌরবে জায়গা করে নেয় যাত্রা দলে। সেদিন থেকে অদ্যাবধি যাত্রার পালায় সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে পরিবেশিত হচ্ছে সিরাজদৌলা। জনপ্রিয়তার বিচারে অদ্যাবধি শচীন বাবুর সিরাজদৌলা একমেবাদ্বিতীয়তম। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি অন্য কোনো নাটক। ৭৪ বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী দর্শক গভীর আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখে যাচ্ছে সিরাজদৌলা। কারণ সিরাজদৌলা কেবল একটি নাটক নয়, সিরাজদৌলা তার জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির নাম। সিরাজদৌলা তার স্বাধীনতার প্রতীক। তার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই এই নামটির তুলনা হয় না।
দুই
এই সিরাজদৌলা নাটকে দেশ ও জাতির এক সঙ্কটকালে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজদ্দৌলা দীর্ঘ এবং বেদনাঘন, উদ্বেগ ও আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে দরবারে বলছেন, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আল্পনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রোরুদ্যমানা জননী নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে, কে শোনাবে জীবন দিয়েও রোধ করবো মরণের অভিযান।’ এই দীর্ঘ সংলাপটি দর্শকের মর্মমূলে আজও অবিরত ক্ষত সৃষ্টি করে যাচ্ছে। কারণ যাদের আশা দেয়ার কথা ছিল, ভরসা দেয়ার কথা ছিল—তারা সবাই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বিদেশি সাদা চামড়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল নিজেদের আত্মা। এজন্যই ‘হাজার হাজার সৈন্য পলাশীর প্রান্তরে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল আর পরাজয় পিছন থেকে এসে জাতির ললাটে কলঙ্কের কালিমা মাখিয়ে দিয়ে গেল।’
কী কুক্ষণেই যে শচীন সেনগুপ্ত এই সংলাপগুলো লিখেছিলেন, ভেবে আজও মাথায় হাত দিতে হয়। কারণ সেই যে ২৫৫ বছর আগে পলাশী যুদ্ধের দিনকয়েক আগে সিরাজদৌলার মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন, যে বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। সেই দুর্যোগ যেমন ১৯৩৮ সালে নাটক রচনার সময় ছিল, তেমনি ২০১২ সালেও বহাল তবিয়তে জাতির মাথার ওপর জমাট বেঁধে আছে। এতটাই জমাটবদ্ধ যে, সহসা যে তা মেঘমুক্ত হবে তার কোনো আশাই নেই।
রাজনীতিতে এখন শুধু ‘রাজ’। ‘নীতি’ উধাও হয়ে গেছে সেই কবে। অর্থনীতির অর্থ এবং নীতি দুটোই আজিমপুর আর বনানীতে সাড়ে তিন হাত কবরের নিচে চাপা পড়েছে। আদর্শ, মূল্যবোধ, মানবিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর আইনের শাসন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ফারাক্কা লাঞ্ছিত পদ্মার বুকে। যানজটে লটকে গেছে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দুর্নীতি, হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানি, সবার ওপর ঘৃণা, সংশয় আর সন্দেহ এখন পিশাচের মতো খুবলে খাচ্ছে আমাদের শ্যামল কোমল পাললিক মৃত্তিকা। আমাদের হৃিপণ্ড।
আধিপত্যবাদের দাঁত ঘষটানি দেখার জন্য এখন আর সীমান্তে যাওয়ার দরকার হয় না। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে তাদের অনুচররা বাসা বাঁধেনি। এখন দেশপ্রেমিকদের বানানো হচ্ছে ভিলেন, আর ভিলেন বীরের মুকুট মাথায় দিয়ে জেঁকে বসেছে সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবনের সর্বত্র। পলাশীর আগের মুর্শিদাবাদ আর আজকের ঢাকার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক অবশিষ্ট নেই।
এই দুর্বিষহ অবস্থা আরও বেশি বেশি ঘনীভূত হয় পলাশী দিবস এলে। তখন নতুন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের এদেশীয় দাললারা। তারা অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে কষে গালাগালি দিতে থাকে হতভাগ্য নবাব সিরাজদৌলাকে। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো, যা কিছু তার নিজস্ব, যা কিছু তার অর্জন—সেগুলোকে পদপিষ্ট করার পাশাপাশি আচ্ছা রকমভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য শুরু করে সিরাজদৌলা সম্পর্কে। ক্ষেত্রবিশেষে নিখাদ গালাগালিতে পর্যবসিত হয় এই বিবমিষা। যেন সিরাজদৌলার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করাই এই শ্রেণীর লেখক-বুদ্ধিজীবীর কাছে সর্বশেষ ফ্যাশন।
এই গালিবাজদের শরীরে যে রক্তস্রোত বয়ে যায় এবং কী কারণে এরা সিরাজবিদ্বেষী, তার নতিজা পেশের আগে আরও একটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রতি বছরই আমাদের এই শ্রেণীর জনমণ্ডলী বিশেষ একটি বিষয় নিয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে। তাল, লয়, মাত্রা জ্ঞান হারিয়ে স্তাবকতা, প্রশংসা ও বিশেষণ প্রয়োগের জন্য পাগল হয়ে যায়। এক ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন মাতলামি আর কী?
তিন
এবার আমাদের বঙ্গপুঙ্গররা অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। বলা যায়, প্রণব বন্দনার মচ্ছব চলছে এখন বাংলাদেশে। বিগলিত লেখক, রাজনীতিবিদ, কলামিস্টরা লিখছেন—বাঙালির হাজার বছরের সৌভাগ্য যে একজন বাঙালি প্রথমবারের মতো ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত। আমরা ধন্য। প্রণব মুখোপাধ্যায় মহান। তিনি মহামহিম। তিনি এশিয়ার শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। অনেকে তাকে এশিয়ায়ও আটকে রাখতে নারাজ। তারা বলছেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। তিনি শ্রদ্ধেয়। তিনি পণ্ডিত। তিনি বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রনেতা। তিনি নম্র। তিনি বিনয়ী। তার জ্ঞানের তুলনা কেবল অগণন নক্ষত্রখচিত আকাশ।
বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের মহান বন্ধু। তিনি অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের আপনার চেয়ে আপন মানুষ তিনি। বাংলাদেশের জন্য তার ভালোবাসা বঙ্গোপসাগরের পানির চেয়েও বেশি। যদি তার জন্ম না হতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না।
এই বেআক্কেল মূর্খদের কে বোঝাবে যে, পদ্মা নদীকে হত্যা করার জন্য যে ক’জন মানুষ দায়ী, তিনি তাদের একজন। যে টিপাইমুখ নিয়ে উত্কণ্ঠায় অধীর আজ বাংলাদেশ, তিনি তার অন্যতম উদ্যোক্তা। ভারতের রক্তপিপাসু বিএসএফের হাতে প্রতিদিন যে বাংলাদেশের মানুষ খুন হয়, সেজন্য তিনি একবারের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেননি। বিএসএফের বিচার তো দূরের কথা।
তিনি সিডরবিধ্বস্ত উপকূলীয় বাংলাদেশের একটি গ্রাম নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিলেন, দেননি। তিনি তাদের মোসাহেব ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের সময় ৫ লাখখ টন চাল দিতে চেয়ে একটা কণাও দেননি। উপযুক্ত মূল্য দিতে চাওয়ার পরও দেননি। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার জন্য সামান্যতম সহানুভূতিও তার কাছ থেকে বাংলাদেশ পায়নি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সত্য। সেজন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে দাঁড়ানোটাও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে। এডওয়ার্ড কেনেডি, তাকাশি হাওয়াকাওয়া, জন স্টন হাউজ কিংবা অদ্রে মালরোর মতো একক ব্যক্তি হিসেবে নয়। তার দাঁড়ানোটা ছিল ভারতের কৌশলগত সিদ্ধান্তের ফসল।
আরও একটি জিনিস দেখবার। আমাদের দাস্য মানসিকতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এক চক্ষু অন্ধ ব্যক্তির মতো আচরণ করে। তাদের যদি দুই চোখই খোলা থাকতো তাহলে দেখতে পেত, ভারতের যে রাজ্যের তিনি বাসিন্দা সেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্তু তাকে নিয়ে মোটেই আমাদের দেশের লোকজনদের মতো লাফালাফি-ফালাফালি করছে না। তারা মোটেই মাত্রাজ্ঞান হারায়নি। বিশেষণ প্রয়োগের বন্যাও সেখানে হয়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরিষ্কার বিরোধিতা করছেন প্রণব বাবুর। তার বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলছেন, নামেই তিনি বাঙালি এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই করেননি।
যাদের মানুষ প্রণব বাবু তারা তার ব্যাপারে উদাসীন এবং বিরোধী। আর আমরা যারা বাইরের লোক, তাদের ঢাকের শব্দে কান ঝালাপালা। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই।
অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন একবার। আমাদের গবেটগুলোকে মানুষ বানানোর দায়িত্ব কে নেবে? দায়িত্ব নিলেও হয়তো এরা সুস্থ হবে না। কারণ এর আত্মা এদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তা বন্ধক পড়ে গেছে অন্যত্র। এখন হাজার চাইলেও এদের আর ফেরার উপায় নেই।
চার
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভ আর আমাদের মীরজাফর সাহেব মিলে পলাশীর মাঠে যুদ্ধ নামের প্রহসন করে কেড়ে নিয়েছিল বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা। এই প্রহসনের আড়ালে ছিল নিম্নশ্রেণীর নিকৃষ্ট কুিসত ও জঘন্য প্রকৃতির ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা। এই ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সিরাজদৌলা।
এখন নিজেদের এই বেঈমানি আর জটিল-কুটিল জালিয়াতি-ষড়যন্ত্রকে যদি আড়াল করা না যায় তাহলে পলাশীর যুদ্ধকে জায়েজ করা যায় না। এজন্যই নিজেদের যদি হিরো সাজতে হয় তাহলে সিরাজকে ভিলেন বানানো ছাড়া অন্য পথ তো নেই। সিরাজকে যত নিচু ও নোংরা করে দেখানো যাবে, ততই উজ্জ্বল হবে তাদের নাম। এজন্যই সিরাজদৌলার চরিত্র হননের কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অব্যাহতভাবে চালিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার। এই কাজে তারা লাগিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ভারত প্রবাসী সাদা চামড়ার সায়েব লেখকদের। আর সবচেয়ে বেশি সাহায্য তারা পেয়েছিল তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রডাক্ট কলকাতাকেন্দ্রিক অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি ও পদোন্নতি-ভিখারী বাবু-বুদ্ধিজীবীদের। জাতীয় ইতিহাসের কলংক তথাকথিত জমিদার শ্রেণীর। তারও আগে মীরজাফরের সময় থেকে কিছু বেতনভুক্ত ইতিহাস লিখিয়েদের দ্বারা কোম্পানি নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে উত্পাদন করিয়েছিল ইতিহাস। পাশাপাশি পথে-প্রান্তরে সিরাজদৌলাকে হেয় করার জন্য, তার ভাবমূর্তি বিনাশ করার জন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল ভাড়াটে লোকজন। গুজব ও গল্প ইতিহাসের নামে তাই চলে আসছিল তখন, এমনকি এখনও।
খুব সঙ্গত কারণেই বিজয়ী পক্ষ পরাজিতের স্কন্ধকে নিজেদের পাপ স্থাপনের সুউচ্চ মঞ্চ বানিয়েছে। ফলে সত্য হয়েছে মিথ্যা, মিথ্যা পেয়েছে সত্যের সম্মান। আর এই মিথ্যাচার, লোককথা, গল্পকে বাছ-বিচার না করেই ইতিহাসের নামে, গল্পে, কবিতায়, মহাকাব্যে দেদার পরিবেশন করেছে বাংলাভাষী মরুদণ্ডহীন কবি ও গদ্যকাররা।
উপনিবেশবাদের পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করে সেদিন নাম ও অর্থ কামিয়েছিল রাম রাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কিংবা কবি নবীন চন্দ্র সেনরা।
মাত্র একজন মানুষ এই অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেই ১৮৯৮ সালে। তিনি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়। তার ‘সিরাজদৌলা’ গ্রন্থ দিয়ে উদঘাটন করেছিলেন আসল ইতিহাস।
কিন্তু তার হাজার কোশেশ সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক ও সাম্রাজ্যবাদের আদর-আহ্লাদে যারা বড় হয়েছিলেন তাদের ছাও-আণ্ডা, বাল-বাচ্চারা আজও সমান তালে সিরাজদৌলার চরিত্রে কালি মাখিয়েই যাচ্ছেন।
সম্প্রতি এই পাপ ও পঙ্কে গা ভাসিয়েছেন বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নববর্ষ সংখ্যা সানন্দায় তিনি ‘মাত্র দশ-বারো ক্রোশ দূর’ নামে একটি গল্প লিখেছেন। সেই গল্পে তিনি দেখিয়েছেন সিরাজদৌলা লম্পট, বদমায়েশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুনীল আমার মতো অখ্যাত নন, বিখ্যাত লেখক। তার সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলতে বাধে আমার। কিন্তু সত্যের স্বার্থে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তিনি তার রক্ত ও মগজে বহন করে চলেছেন সেই ঔপনিবেশিক শাসক তথা সাম্রাজ্যবাদের দালালদের উত্তরাধিকার। নইলে এই ফালতু কথা তিনি লিখতে পারতেন না।
টেনিসন তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক ‘বেকেট’-এর ভূমিকায়, তার নাটকে স্থান পাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বিদেহী আত্মার উদ্দেশে একটি চমত্কার চতুর্দশপদী কবিতা লেখেন। তার কয়েকটি চরণ খুবই চমত্কার :
“আমি যদি তোমাদিগকে এমন কথা বলাই,
যাহা তোমরা বল নাই—
যদি তোমাদের সদগুণ বিলুপ্ত করিয়া ফেলি,
এবং তোমাদিগকে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে গঠন করি,
তাহা হইলে হে প্রাচীন প্রেতাত্মাগণ
আমার উপর ক্রুদ্ধ হইও না।
কারণ যিনি আমাদিগকে ঠিক জানেন,
তিনি জানেন, যে কেউই নিজের একদিনের
জীবনের যথার্থ বৃত্তান্ত লিখিতে পারে না,
পৃথিবীতে আর কেহই তাহার জন্য লিখিয়া দিতে পারে না।”
যদি এরকম দায়বদ্ধতা কারও মধ্যে থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি যত বড় লেখকই হন, নিজের পাপকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ঘাড় উঁচু করে বলবেন না, ‘উপন্যাস লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলবদ্ধ নহেন। ইচ্ছামত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় নিতে পারেন।’
a_hyesikder@yahoo.com

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

দীপুর বচন : কালামে আবুল মা’ল : ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ’



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কালো বিড়াল, দিলীপ বড়ুয়ার প্লট প্রাপ্তি, ইনু এমপির খালেদা খেদানোর হম্বিতম্বি, আহাদ আলী সরকারের ছেড়া পাঞ্জাবি-তত্ত্ব কিংবা লতিফ বিশ্বাসের ৭-তলা বাড়ি আমার আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। গত সাড়ে ৩ বছরে আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ যেসব কীর্তি-কাহিনী স্থাপন করেছেন, তা হয়তো পর্যায়ক্রমে আরও সবিস্তারে জানা যাবে।
আমার চোখের সামনে এখন মানুষ। নাফ নদীতে ভাসমান মানুষ। তাদের ক্ষুধার্ত আতঙ্কিত স্বজন পরিজন। তাদের পেছনে মৃত্যু, অগ্নিসংযোগ, মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং লুণ্ঠন বাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বরতার পৈশাচিক উল্লাস। ওই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে ছুটে আসছে বাংলাদেশে, বাঁচার জন্য, আশ্রয়ের জন্য। নাফের পানিতে লাশ। মাথার উপরে ঝড় বৃষ্টি। উত্তাল ঢেউয়ে ডুবু ডুবু তাদের নৌকা ভরা ভয় আর ক্ষুধা।
ফিলিস্তিনিদের মতো রোহিঙ্গাদেরও কেউ নেই। তারা যে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে সেই বাংলাদেশ সরকার বেঁকে বসেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সরকার হুঙ্কার দিয়ে বসেছে, আর ১ জন রোহিঙ্গাকেও এদেশে আশ্রয় দেয়া হবে না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
পেছনে মৃত্যু। সামনে বাধার বিন্দ্যাচল। নিচে পানি। ওপরে খোলা আকাশ। মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে তারা যখন ভাসছে আর কাঁদছে, সেই সময় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দাঁড়িয়ে ৩০০ বিধিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তার বক্তব্য পেশ করছিলেন। তার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ছিল দেখার মতো। কণ্ঠে ছিল অসীম দৃঢ়তা (উনারা শক্তের ভক্ত নরমের জম, লোকে বলে)। দুর্বল প্রতিপক্ষ পেলে জবান পুরোদস্তুর খুলে যায়। তার কথার সংক্ষিপ্তসার হলো, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে আমরা স্বাক্ষর কিংবা অনুস্বাক্ষর করিনি। আন্তর্জাতিক আইনের কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের ওপর নেই। প্রথাগত আইনের কোনো দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা কোনো শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য নই। তাদের জন্য আমরা আমাদের দেশের সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য নই।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই যে তার কণ্ঠ দিয়ে প্রচুর লাল মরিচের গুঁড়া বের হচ্ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সঙ্গে তিনি নতুন বাণী যুক্ত করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তার কথায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নাকি মিয়ানমারের রাখাইনদের হাতে রোহিঙ্গা নিধনের জন্য দায়ী। তারাই নাকি মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের উসকে দিয়ে এসেছে।
হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না। দীপু মনি ডাক্তার মানুষ। তার মাথায় গোলমাল আছে তাও বলার সাহস পাচ্ছি না। তবে ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলে কেষ্টা বেটাই চোর’ নামক রোগটি আওয়ামী কর্তাদের অতি পুরনো ব্যাধি। এবার তারা তাদের সে ব্যাধিকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেন। দেশের সীমানার বাইরেও এখন থেকে যা কিছু যেখানে ঘটবে তার সব দোষ ধরে নিতে হবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর।
তো জামায়াতের নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে কী করছেন সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে ডা. দীপু মনির এই বিখ্যাত আভিধানিকভাবে নির্ভুল বাক্য বর্ষণ সেদিন শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল যেন মধ্যযুগীয় রক্তপিপাসু চেঙ্গিস খান কিংবা বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকু খানের প্রেতাত্মা যেন বহু শতাব্দী পরে মহিলা রূপ ধরে আমাদের পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। যেন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে, চমত্কার পারফিউম গায়ে মেখে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন। তার ঠোঁট ও জিহ্বাকে সেদিন আমার মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল ওগুলো হৃদয়হীন পাথর কিংবা লোহায় তৈরি। আর মাননীয় মন্ত্রীকে মনে হচ্ছিল বিমানবিক রোবট। ন্যায়, নীতি, মানবতা, এগুলো যার কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। শুধু অভিধানই সত্য। মনে হচ্ছিল সেই কবিতার পঙক্তি :
‘বালিকা ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
পড়েছে ব্যাকরণ, পড়েছে মূল বই।’

—নইলে ভুপেন হাজারিকার গানের গন্ধ থাকতো তার কণ্ঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না।’
দেড় হাজার বছর আগে পবিত্র কোরআন বলে গেছে, ‘মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত।’ ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি চণ্ডীদাস বলে গেছেন,
‘শুনহে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’
এই একই বাণীর অনুরণন পাই বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ জাতীয় কবি নজরুলের মধ্যে কবিতায় :
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।’

‘বালিকা’ দীপু মনি ‘বাফার স্টেট’ বোঝে না। তিনি এত বড় বড় নীতিকথার নির্গলিতার্থ অনুধাবন করবেন কী করে! তার সমস্যাটা আমাদের বুঝতে হবে। তিনি যে কালচারের মধ্যে বড় হয়েছেন তার মূল কথা হলো, ‘অনুকূল বাতাসে বেড়ে ওঠো, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লুকিয়ে পড়।’ বিপদ যতক্ষণ নাই ততক্ষণ গলা ফাটাও। বিপদ দেখলে নেতার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে শপথ নিতে ছুটে যাও। অথবা গর্তে ঢুকে পড়।
লজ্জা নারীর ভূষণ হলেও আমরা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নারী ও পুরুষের বাইরেই দেখি। নইলে তিনি শরমের মাথা খেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রসঙ্গ টানতেন না। টানলেও সঠিকভাবেই টানতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। হয়তো দেখেননি। দেখলে রোহিঙ্গাদের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতে পারতেন না। আমাদের অবস্থা ’৭১ সালে যা ছিল আজকের রোহিঙ্গাদের অবস্থা তা-ই। পার্থক্য, আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম আর হতভাগা রোহিঙ্গারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে রত।
পাকিস্তানের নিজস্ব সমস্যা বলে ভারত যদি তাদের খুনি বিএসএফকে বর্ডার নিশ্ছিদ্র করার আদেশ দিত, তাহলে আমাদের কী হতো? দীপু মনিকে ভেবে দেখতে বলি।
আমাদের সংবিধান তো পরিষ্কারভাবে বলে মানুষ ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াও। শোষিত বঞ্চিত নিগৃহীতের পাশে দাঁড়াও। আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দাও। ক্ষুধার্তকে খাবার দাও।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে যে কোনো বিচারেই ডা, দীপু মনির বক্তব্য মানবতাবিরোধী তো বটেই, একইসঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসেরও পরিপন্থী।
মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর জন্য কোনো কুপরামর্শ দীপুকে কেউ দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ একবাক্যে বলবে, ‘ফ্লাইং পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ হিসেবে যে খ্যাতি ও সুনাম আপনার আছে, তা কাজে লাগিয়ে দয়া করে একবার ইয়াঙ্গুন ঘুরে আসুন। প্রয়োজনে জাতিসংঘে যান। বড় বড় দেশগুলোতে যান। তাদেরকে বাংলাদেশের সমস্যাটা বলুন। রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর পথ বােল দিন। যেভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব চষে বেড়িয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
তা না করে তোতাপাখির মতো, দায়িত্বজ্ঞানহীন অবোধ প্রাণীদের মতো মিয়ানমারের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বাণী দেবেন—সেটা খুব খারাপ কাজ হবে।

দুই
আমাদের রাজনীতিতে ‘বাংলিস’ ভাষার উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর। বাংলিস ভাষা মানে বাংলা ও ইংরেজি মিশেল। একটা জগাখিচুড়ি। এটা আবার হতে হবে একই বাক্যবন্দের মধ্যে। তাইতো তিনি বলেছিলেন, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।’
এই আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর অন্যান্য আবিষ্কারকের মতো বাবরকেও সহ্য করতে হয়েছে অনেক গঞ্জনা, গালমন্দ, ঠাট্টা, ইয়ার্কি। তিনি সেসব নীরবে হজম করেছিলেন। কিন্তু তার আবিষ্কার যে এতদিনেও বৃথা হয়ে যায়নি, এটা যে ছিল সত্যি একটা নতুন জিনিস এবং দরকারি তা আবারও প্রমাণ করলেন আমাদের বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মা’ল আবদুল মুহিত। বাবরের এই বাংলিস ভাষা বিস্তারের নিশান এবার তিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে হাতে তুলে নিয়েছেন। বাবরের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি পরম মমতায় আপন কাঁধে তুলে নিয়ে সূচনা করেছেন নতুন যুগের।
শেয়ারবাজার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের গত ১৩ জুন বলেছেন, শেয়ার মার্কেট যথাযথভাবে কাজ করছে না। ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ।’ তিনি রাজ্যির বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন, তবে এই দুষ্টু বাজারের জন্য যেটা ওষুধ সেটা আসছে।
শেয়ার বাজারের প্রতি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নতুন নয়। এর আগেও তিনি অনেক উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে জাতিকে ফেড আপ করে ছেড়েছেন। এবার তার এই ‘বাংলিস’ শব্দ ব্যবহারের কারণে যা একটু নড়েচড়ে বসেছে সবাই।
তার এই বাংলিস ব্যবহারের সাহস ও প্রচেষ্টা দেখে নিশ্চয়ই কারান্তরালের নির্জন কক্ষে বসে বাবর সাহেব বেশ কৌতুক অনুভব করছেন। সেই কৌতুকের ছিটেফোঁটায় দেশবাসীও আজ আপ্লুত।
মুহিত সাহেব প্রবীণ মানুষ। অনেক তার নামডাক। তিনি আমাদের মধ্যে আরও দীর্ঘদিন বাঁচুন। তার সম্পর্কে কটুবাক্য ব্যবহার করা অসমীচীন হবে। তবে তার সম্মানে একটা মানপত্র কিংবা এক ধরনের এপিটাফের খসড়া করে পাঠিয়েছেন আমাদের এক পাঠক। সেটিই তুলে ধরছি :
ক) এখানে শুয়ে আছেন এমন একজন যিনি বাংলিস ভাষা প্রচলনে অপরিসীম গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন।
খ) শেয়ারবাজারকে গোরস্থান বানিয়ে সেই গোরস্থানে ৩৩ লাখ লগ্নিকারীকে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে তিনি অমর কীর্তি স্থাপন করে গেছেন।
গ) তিনি এমন একজন ছিলেন যিনি শেয়ারবাজারকে কখনও ফটকা বাজার, কখনও দুষ্টু বাজার, লগ্নিকারীদের জুয়াড়ি বলে আখ্যায়িত করে অপূর্ব বচনামৃত বর্ষণ করে গেছেন।
ঘ) তিনি কথায় কথায় রাবিশ শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস হিলারি ক্লিনটন এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও ‘রাবিশ’ বলে গাল দেন। এই রাবিশ তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিল।
ঙ) তিনি সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এক প্রিয় দালাল হয়ে প্রচুর কালিয়া-কোপতা, বিরিয়ানি, পায়েস খেয়ে হজম করে, অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হতে পেরেছিলেন। অতঃপর বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে গেছেন।
চ) আরেক ‘আবুল’ যে পদ্মা সেতু করতে পারলো না তার জন্যও নাকি আমাদের এই মহান ‘আবুল’ দায়ী। অবশ্য আল্লাহ সব ভালো জানেন।

তিন
মানুষ যখন দুর্ভিক্ষে মরছিল তখন আওয়ামী লীগের নেতা-এমপিরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছিল। তাদের সৃষ্ট গডফাদারদের হাতে যখন মানুষ মরছিল তখনও নির্বিকার ছিল এই দলের লুণ্ঠন মানসিকতা। এবারও বলাবাহুল্য, গুম খুনের মচ্ছব চললেও সৈয়দ আবুল হোসেনদের হাসি ফুরায় না। এই হাসির কিঞ্চিত্ নতিজা পেশ করেছেন তরুণ এমপি গোলাম মওলা রনি। তার নাকি সবকিছুতেই হাসি পায়।
তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘একবার বাস খাদে পড়ে গেল। অনেক আহত হলো। তিনি তা দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। দৌড়ে নিকটস্থ শস্য ক্ষেতে গিয়ে এক পেট হাসলেন।’
আরেকবার নৌ দুর্ঘটনার মধ্যেও তার হাসি পেয়েছিল। বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে ছেলেমেয়ে, বুড়া-গুঁড়া সবাই কান্না শুরু করলো। কাঁদলে একেকজন একেক রকম মুখভঙ্গি করেন। চিত্কারের শব্দও ভিন্ন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে আবার দেখায় দরদ। তিনি হাসি থামাতে পারলেন না।
নিজেই আবার লিখেছেন, বিক্ষুব্ধ লোকজন সেদিন আমাকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
প্রিয় পাঠক, দেশকে, দেশের মানুষকে দুঃখের দরিয়ায় ডুবিয়ে, দম্ভ করে যারা কথা বলে, বাজে আচরণ করে, নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক ভঙ্গিতে হাসে, সত্যি সত্যি তাদের উপযুক্ত ওষুধ হলো লঞ্চ থেকে পানিতে ফেলে দেয়া। গোলাম মওলা রনি তার বিকৃত রুচির হাসির ফিরিস্তি দিতে গিয়ে জাতিকে এর প্রতিবিধানের পথও বাতলে দিয়েছেন। এই তরুণ এমপি মহোদয়কে সে জন্য ধন্যবাদ।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

জসীমউদ্দীনের ‘মাইনক্যা’ : ‘অজ্ঞ রাষ্ট্রদ্রোহী’ স্পিকার ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত স্যাডিস্ট’ বিচারপতি



আবদুল হাই শিকদার
এক
জনগণ শিহরিত। কম্পিত। আতঙ্কিত। স্তম্ভিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব দেখে তারা বিব্রত, বিচলিত, হতাশ। দেশে হচ্ছেটা কি?
সড়ক ভবন নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে ২৯ মে জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেছিলেন, সরকার, সংসদ ও বিচার বিভাগ যে কোনো প্রতিষ্ঠান সীমা লঙ্ঘন করলে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তিনি আরও বলেছিলেন, আদালত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা ভালো দেখায় না। কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।
এই বক্তব্যের পর যথারীতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বিষয়টি আদালতের গোচরে আনলে বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী যা বলেন তার সারসংক্ষেপ হলো, এটা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। স্পিকার সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকানি দিয়েছেন। তার বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। স্পিকার তার পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। ওই পদে থাকার অধিকার তার নেই। স্পিকারের মন্তব্য আনপ্রিসিডেন্টেড। তিনি একজন আইনজীবী। তার তো অ্যাডভোকেট পদ ব্যবহার করা উচিত নয়। স্পিকারের মনে হয় বিচার বিভাগ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। স্পিকার তার অজ্ঞতা দেখিয়েছেন। একজন স্পিকার এত অজ্ঞ হতে পারেন, তা আমরা ভাবতে পারি না। স্পিকারের বক্তব্য শুধু অজ্ঞতাই নয়, তার বক্তব্য অমার্জনীয়। (স্পিকার সংসদের প্রতীক) ওই প্রতীক হতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। পড়ালেখা জানতে হয়। এটা হলো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর।
বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর এই বক্তব্যের পর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সংসদ সদস্যরা। তারা পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সার্বভৌম সংসদের ওপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী মানিক হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দয়ায়। কোনো লিখিত পরীক্ষা ও যোগ্যতা ছাড়াই তিনি বিচারপতি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার গত আমলে এ লোককে যোগ্যতা ছাড়া, পরীক্ষা ছাড়া হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ করেছে। এ ব্যক্তি বিচারক হওয়ার পর সারাদেশের সচিব, আইজিসহ যত ভদ্রলোক আছেন তাদের সামান্য কারণে হাইকোর্টে ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে বেইজ্জতি করেন। এ বিচারপতি সেই ব্যক্তি-যিনি বিমানে সামনের আসনে বসার জন্য বিমানের এমডিকে হাইকোর্টে ডেকে বেইজ্জতি করেছেন। এই ব্যক্তি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। তিনি কোনো সুস্থ মানুষ নন।
শামসুদ্দিন মানিক ভাগ্যবান। আমাদের আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে তাকে বিচারক করেছেন। বিএনপি তাকে কনফার্ম করেনি। আমরা এবার ক্ষমতায় আসার পর তাকে কনফার্ম করেছি। তিনি আজ আমাদের বিরুদ্ধে, পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে মন্তব্য করছেন। আর একজন আইনজীবী আছেন মনজিল মোরশেদ। তার কোনো কাজ নেই। খবরের কাগজ পড়ে শামসুদ্দিন মানিকের কাছে যান এবং তিনি রুল ইস্যু করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আমরাই স্লোগান তুলেছিলাম, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা। এ স্লোগানে প্রতিরোধ গড়ার পর আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি লুঙ্গি পরে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
শামসুদ্দিন মানিক একজন স্যাডিস্ট। তিনি মানুষকে অপমান করে মজা পান। তা না হলে একজন ট্রাফিক পুলিশ, যিনি হয়তো তাকে দেখেননি, স্যালুট না দেয়ায় গাড়ি থেকে নেমে তাকে কানে ধরে উঠবস করিয়েছেন। ইত্যাদি।
জাতীয় সংসদ ও উচ্চ আদালতের এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান আমাদের দেশে অভূতপূর্ব। শাসকগোষ্ঠীর নানা কুকীর্তি, দুর্নীতি, ঔদ্ধত্য ও সীমা লঙ্ঘনের কালচার এবং হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার প্রতিফলন ঘটেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তাদের অন্তর্গত বিরোধ বহুদিন থেকেই ফুঁসছিল। এবার সেই বিরোধ ফুলে-ফেঁপে পেকে বিস্ফোরিত হয়েছে। আর এর দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় জীবনের সর্বত্র। আর হতবাক জনগণকে শুনতে হচ্ছে তাদের সংসদ পরিচালিত হচ্ছে একজন ‘অজ্ঞ রাষ্ট্রদ্রোহী’ স্পিকার দ্বারা আর বিচারব্যবস্থা পড়েছে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত স্যাডিস্ট’ বিচারপতির খপ্পরে।
এখন এই বিচারপতিকে ইমপিচ করতে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে সংসদ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর দাবি উঠেছে। এই দাবির পর গত বুধবার এজলাশে বসেননি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। অন্যদিকে অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনও চলে গেছে।
অবশ্য আশার কথা, সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, একজন বিচারকের দায় গোটা জুডিশিয়ারি বহন করতে পারে না।
আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রেরই বারোটা বাজিয়েছে এই সরকার। এক্ষেত্রে কি হয় তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি কি? অন্যদিকে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে গণতন্ত্র।
দুই
১৯৫৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মঞ্চে প্রথমবারের মতো অভিনীত হয় কবি জসীমউদ্দীনের অতি বিখ্যাত নাটক ‘বেদের মেয়ে’। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেন বহির্বিশ্বে।
আজকের লেখা শুরুর সময় আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা হাতড়ে দেখি বইটি নেই। শরণাপন্ন হলাম বাংলাবাজারের প্রকাশক বন্ধু এম আর মিলনের। তিনি বইটি জোগাড় করে তড়িঘড়ি আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। তাতেই রক্ষা হলো।
তো এই নাটকে একটি চরিত্র আছে ‘মানিক’ নামে। নাটকে যাকে বার বার ‘মাইনক্যা’ নামে ডাকা হয়। মাইনক্যা হাড়বজ্জাত। গ্রামের মোড়ল সাহেবের সব অপকর্মের দোসর। কখনও সে নিজে থেকেও মোড়লকে জড়িত করে নানা পাপে। আবার মোড়লও তাকে দিয়ে দেখিয়ে বেড়ায় নিজের ক্ষমতা।
এই মাইনক্যা একদিন খবর নিয়ে আসে মোড়লের কাছে। গ্রামে এবার যে বেদের বহর এসেছে তাদের মধ্যে ‘সুডৌল সোন্দর হলদে পঙ্খীর বাচ্চার মতো’ এক বাইদানী এসেছে। নাম চম্পা। মাইনক্যার প্ররোচনায় মোড়লের মাথায় ভর করে শয়তানি। বেদেদের সবাইকে ডেকে আনে মাইনক্যা মোড়ল সাহেবের বৈঠকখানায়। সেখানে বেদের সরদার চম্পা বাইদানীর স্বামী গয়া বেদেকে মোড়ল বলে, ‘শোন বাইদ্যা, তোমার বাইদানীরে আমি চাই।’
গয়া বেদে বললো, ‘মোড়ল সাহেব! আমরা বাইদ্যা জাত, ঘর নাই, বাড়ি নাই। দ্যাশে দ্যাশে ঘুইরা বেড়াই। পথের মা আমাগো মা, পথের বাপ আমাগো বাপ। ওমন কথা কইয়েন না। আপনাগো বল-ভরসাতেই আমরা ঘুইরা ফিরি।’
মোড়ল বললো, ‘দেখ বাইদ্যা। ওসব কাকুতি মিন্নতির কথা নয়। সুজা কথায় যদি তোমার বাইদানীরে দিয়া যাইবা ত দিয়া যাও, নইলে কি আমি করবার পারি—ক’ দেহি মাইনক্যা। ক’ ত?’
মাইনক্যা জানে তাকে কি বলতে হবে। সে উচ্চকণ্ঠে বললো, ‘মোড়ল সাব। আপনি কি করবার পারেন, তা কি আর কইতিই অবি? ওইত সেবার কুতুবদ্দি একটু তেড়িবেড়ি করছিল, তার বাড়িতি আগুন জ্বালায়া, ভিটার উপর নাঙ্গল চাষ্যা বাগুনির খ্যাত লাগায়া দিছিলেন; কুতুবুদ্দিরে পদ্মা নদীতে ফেইল্যা দিছিলেন; গাজনডাঙ্গার ছমিরদ্দি...’
চামচার বর্ণনায় তৃপ্ত মোড়ল গয়া বেদেকে বলে, ‘বুঝলা’। গয়া বেদে কাকুতি মিনতি করে। রাতের মধ্যেই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি চায়। ক্রুদ্ধ মোড়ল মাইনক্যাকে বলে, ‘গ্রাম ছাইড়া যাবি? ক’ তো, ক’ তোরে মাইনক্যা—কি ঠিক কইরা রাইখ্যাছি আজ?
মাইনক্যা মোড়লের যথার্থ সহচর। সে বলে, ‘আজ রাইতে সমস্ত বাইদ্যার নাও ভাইঙ্গা চুরমার কইরা দিবেন, সমস্ত বাইদ্যার গলা কাইট্টা ফালাইবেন।’
গয়া বেদে বলে, ‘দোহাই দোহাই, মোড়ল সায়েব।’
মোড়লের সে দিক ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার চামচা মাইনক্যাকে বলে, ‘এহনই কি, ক’ রে ক মাইনক্যা! আরও কি করবো আমি, আমার হুকুমডা কয়া দে।’
মাইনক্যা তো আসলে মোড়লের মাইক্রোফোন। সে বলে, ‘বাইদ্যা-নৌকার যত পুলাপান ছোট ছেলে আছে তাগো আছড়াইয়া মারবেন। সব বাইদ্যানীর মাথার চুল কাইটা বে-বস্ত্র কইরা দেশ থইনে খেদায়া দিবেন। আর সেই সোন্দর বাইদানীরে ধইরা রাখবেন।’
মাইনক্যার মুখে নিজের ক্ষমতার কথা শুনে বিগলিত মোড়ল বললো, ‘হুনছস বাইদ্যা! কি রকম পেরতাবডা আমার!’
এরপর আর কি। এই মাইনক্যার জন্য গ্রামে ঘনিয়ে আসে বিপদ। বেদেদের সহজ স্বাভাবিক ছান্দিক জীবনধারা তছনছ হয়ে যায়। আর নষ্ট হয়ে যায় চম্পার জীবন। কবি জসীম উদদীনের ‘বেদের মেয়ে’ পরিণত হয় এক হৃদয়ভাঙা ট্রাজেডিতে। এই ‘মাইনক্যা’দের সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে অভিশাপ। কারণ এরা হলো অকল্যাণ ও অমঙ্গলের প্রতীক।
তিন
একবার এক অযোগ্য শীতার্ত ইঁদুরকে এক দয়ালু মুনি রক্ষা করেছিলেন। ইঁদুর একদিন বললো, বিড়াল তাকে মারতে আসে। মুনির বরে ইঁদুর বিড়াল হয়ে গেল। এরপর কুকুরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মুনির বরে বিড়াল থেকে কুকুর হয়ে গেল ইঁদুর। একদিন বললো বনের বাঘ তাকে খেতে আসে। মুনির বরে ইঁদুর কুকুর থেকে পরিণত হলো বাঘে। তারপর একদিন মুনির উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লো ব্যাঘ্ররূপী ইঁদুর। মুনি বললেন, আচ্ছা, তুই আবার ইঁদুর হয়ে যা। ইঁদুর আবার ইঁদুর হয়ে গেল।
আজকের দিনে আমরা, আমাদের শাসকরা যেসব বাঘ বানাই সেগুলোও সেই ইঁদুরের মতো তার স্রষ্টাকেই শেষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। কারণ আজকালকার মুনিদের বাঘ থেকে ইঁদুরে পরিণত করার মতো সততা থাকে না।
যদিও শেষ পর্যন্ত দুষ্টু ছেলেটির মতো পরিণতি কারো কারো হয়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে দুষ্টু ছেলেটি। পথচারী কেউ এলে আচমকা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে পেছন থেকে।
তারপর বিকৃত আনন্দে ফেটে পড়ে। একবার এভাবে আক্রান্ত এক পথচারী তাকে ১০টি টাকা উপহার দিয়ে বললো, খুব ভালো মারতে পার তুমি। তবে এখন যে লোকটি এখান দিয়ে যাবে তাকে যদি মারতে পার তাহলে সে তোমাকে ১০০ টাকা বকশিশ দেবে। টাকার লোভে ছেলেটি অপেক্ষা করতে লাগলো ঝোপের মধ্যে। কিছুক্ষণ পর সেই লোকটি এলো। ছেলেটি যথারীতি তার ওপর পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠিপেটা করে হি হি করে হাসতে হাসতে বললো, এবার আমার ১০০ টাকা দাও।
ছেলেটির দুর্ভাগ্য, ওই লোকটি ছিল একজন বদরাগী পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মুহূর্তের মধ্যে এই ছেলেটিকে পাকড়াও করে ফেললেন। তারপর লোকজন নিয়ে গোটা গ্রাম ঘেরাও করে ছেলেটির পিতামাতাসহ সবাইকে বেধড়ক পেটালেন। সবাইকে বেঁধে নিয়ে চললেন, থানায়। কেন তারা এরকম বজ্জাত ছেলে জন্ম দিয়েছে? কেন তাকে আদব-কায়দা শেখায়নি?
কথায় বলে লোভে পাপ। পাপে হয় মৃত্যু। আর সীমা লঙ্ঘন না করার জন্য সব ধর্মেই বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
চার
কবি শেলীর স্ত্রী ছিলেন মেরী শেলী। কিন্তু কবি শেলীর স্ত্রী হিসেবে নয়, বিশ্ব সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে আছেন তার বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ফ্রাংকেনস্টাইনের জন্য। বৈজ্ঞানিক ফ্রাংকেনস্টাইন এক যন্ত্রদানব তৈরি করেছিলেন অন্যদের ওপর নিজের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য। দুঃখের বিষয়, এই দানবের হাতেই শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিয়ে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছিল তাকে।
মেরী শেলীর ফ্রাংকেনস্টাইন আজ আর মাত্র একটি গ্রন্থ নয়। এটা একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত, অনন্যসাধারণ শিক্ষা হিসেবে অমর হয়ে আছে। আমাদের গ্রাম্য প্রবাদ, অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়—এটাই ফ্রাংকেনস্টাইনের মর্মবাণী। সেই বাণী থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা জ্ঞানী-গুণীরা বলে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা কখনোই শোনে না।
আমাদের মনে রাখা দরকার রাজা আর বানরের গল্পটি। দূরের পাহাড় থেকে প্রতিদিন একটি করে মোহর এনে দেয় বানর। রাজা মোহর হাতে নিয়েই বানরকে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করেন। বানর ব্যথা পেয়ে দূরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। প্রতিদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। উজির নাজিররা রাজাকে বললেন, এটা ঠিক না। এটা অন্যায়।
রাজা বললেন, ঠিক আছে। লাঠিপেটা বন্ধ। পরদিন বানর যথারীতি মোহর আনলো। রাজা বানরকে মারলেন না। বানর অভ্যাস মোতাবেক দূরে গিয়ে বসে রইল। পরদিন বানর মোহর দিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসে রইল। তারপর দিন বসলো রাজার কাছেই। তারপর দিন মোহর দিয়েই বানর গিয়ে বসলো রাজার ঘাড়ে। রাজা এবার উজির নাজিরদের ডেকে বললেন, বোঝা গেল বিষয়টা? কেন ওকে লাঠিপেটা করি। কেন এই নিয়ন্ত্রণটুকু দরকার?
এই অতি দরকারী জিনিসটা যদি আমাদের কর্তারা বুঝে থাকেন, তাহলে ভালো। না বুঝলেও ক্ষতি নেই। কারণ তাদের গাছের গোড়া মারাত্মকভাবে পচে গেছে। এই গাছ কাটার জন্য আর কোনো কাঠুরিয়ার দরকার হবে না। আপনাআপনি এটা ভূপতিত হবে। আমাদের মতো আমজনতার শুধু একটু অপেক্ষা করতে হবে—এই যা।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ২ জুন, ২০১২

ভারতীয় আগ্রাসনের অন্তরলোক : হারিয়ে যাওয়া হায়দারাবাদ



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
উপসংহার : পরাজয় এবং আত্মসমর্পণ
ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাক্ষীদের একজন স্যার মীর লায়েক আলী। যিনি ছিলেন নিজামের পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দেশের প্রধানমন্ত্রী। হায়দারাবাদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং অসহায় সাক্ষী।
সাক্ষী হিসেবে কাশেম রিজভীও ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন। কারণ তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই হায়দারাবাদের জনগণের নেতা। কিন্তু তিনি তার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে যাওয়ার সুযোগ পাননি। কারণ ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখলের পর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন কাশেম রিজভী। মাতৃভূমি হায়দারাবাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার জন্য যিনি নিজের সর্বস্ব উজাড় করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন, সেই কাশেম রিজভীর বিচার হয় দেশদ্রোহিতার অপরাধে। জীবনের বাকি দিন তাকে কাটাতে হয় ভারতীয়দের কারাপ্রকোষ্ঠে। তার কারাবরণ ও মৃত্যুর ভেতর দিয়েই চিরতরে নিভে যায় হায়দারাবাদের প্রাণের প্রদীপ।
উপসংহারে অন্য কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে সেজন্য লায়েক আলীর বর্ণনাকেই হুবহু তুলে ধরছি :
মাঝরাতের দিকে পশ্চিমে দায়িত্ব পালনরত ব্রিগেডিয়ারকে সেনাবাহিনী প্রধানের রুমে প্রবেশ করতে দেখা গেল। তিনি জানালেন, ভারতীয় বাহিনী রাতেই কিছু সময় আগে জহিরাবাদ পার হয়ে হায়দারাবাদের দিকে এগিয়ে আসছে। টুয়েন্টি-ফাইভ পাউন্ডের কামানের সীমায় প্রবেশ করতেই আমাদের বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে এবং চারটি ভারতীয় সেরমান ট্যাঙ্ক ওই হামলায় বিস্ফোরিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনী আবার জহিরাবাদের দিকে পশ্চাদপসরণ করেছে। তিনি মনে করেন, সকালের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী আবার সেখানে উপস্থিত হবে। সে কারণে তিনি ঘটনাবলি তুলে ধরার জন্য নিজেই চলে এসেছেন। তিনি বললেন, তিনি জানতে চান এখন তিনি কী করবেন। তাকে দেখে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল। তিনি চলে যাওয়ার পরপরই সেনাপ্রধান তার সম্পর্কে নিজের মতামত দিলেন। বললেন, তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব ভীত ও বিচলিত। এ অবস্থায় তিনি তার দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত। সেনাপ্রধান হেড কোয়ার্টার থেকে অন্য একজন ব্রিগেডিয়ারকে তার পরিবর্তে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য পাঠাতে মত দিলেন। নতুন ব্রিগেডিয়ারকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো। তিনি রওনা হওয়ার আগে আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, যে করেই হোক ভারতীয় বাহিনীকে এগোতে দেয়া যাবে না। আমি তাকে বললাম, হায়দারাবাদের ভাগ্য এখন তার হাতে। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, তিনি তার সব সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করবেন।
পশ্চিম আবারও যুদ্ধের ময়দানের অতিগুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে পরিণত হলো। পূর্বে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসরের নতুন কোনো খবর পাওয়া গেল না। পশ্চিমে নতুন একজনকে দায়িত্ব দিয়ে আমার স্বস্তি হচ্ছিল না। তাই আমি সেনাপ্রধানকে বললাম যেন তিনি নিজে সেখানে চলে যান। সবকিছু ঠিকঠাকমত চলছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখেন। তিনি চলে গেলেন। তার স্থানে একজন সিনিয়র স্টাফ দায়িত্ব তুলে নিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন এই কর্মকর্তা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং দ্রুত কর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। তিনি পূর্ব এবং পশ্চিমে মাইন পেতে রাখার দিকে জোর দিলেন। সামরিক ও অসামরিক বাহিনীর লোকদের দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন মাইন পুঁতে রাখার জন্য।
তখন ভোর ৪টা বাজে। ১৭ সেপ্টেম্বর। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টাফ আমাকে অনুরোধ করলেন বাড়ি ফিরে কিছু বিশ্রাম গ্রহণের জন্য। আমি দুই রাতের মধ্যে বিশ্রামের তেমন কোনো সুযোগ পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমি বিশ্রামের লক্ষ্যে আর্মি হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রওনা দিলাম। বাড়ি ফেরার পথে শাহ্ মনজিলে একবার দেখা দিলাম। চলে গেলাম সেখানে, যেখানে গোপন তথ্য ডিকোড করা হচ্ছিল। জানতে পারলাম, মুসতাক আহমেদ নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ক নতুন কোনো তথ্য পাঠাননি। বাড়ি পৌঁছে আমি বিশ্রাম নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখনি আমাকে জানানো হলো যে রেলওয়ের চিফ ফোনে হোল্ডে আছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি আমাকে জানালেন, বিবিনগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার তাকে জানিয়েছেন সেখানে গোলাগুলি হচ্ছে এবং ভারতীয় বাহিনী রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে বিবিনগর-হায়দ্রাবাদ রোড দিয়ে। ‘কি’? এটা কীভাবে হতে পারে? বিবিনগর রেলওয়ের কাছে গোলাগুলি হচ্ছে! ভারতীয় বাহিনী কী করে বিবিনগর পৌঁছল? কীভাবে হয়েছে তার উত্তর তিনি দিতে পারছিলেন না। কিন্তু তিনি বললেন, বিবিনগর দিয়েই ভারতীয় বাহিনী আসছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বিবিনগর থেকে রাজধানীর দূরত্ব মাত্র তিরিশ মাইলের মতো। সেই পথে প্রায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে! এটাই ছিল তখন পর্যন্ত আমার শোনা সবচেয়ে ভীতিকর তথ্য। তার মানে শুধু এই হতে পারে যে, হয় ভারতীয় বাহিনী নাকরাকালে অবস্থিত সব প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিয়েছে, অথবা তাদের কোনোভাবে পাশ কাটিয় এগিয়ে আসছে। পূর্বেও তারা দিলামকে পাশ কাটিয়ে হঠাত্ বিদরে উপস্থিত হয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফোন করলাম। আমাকে জানানো হলো, সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পূর্বে কোনো নতুন কিছু ঘটেনি। আমাদের সেনাবাহিনী ঠিকমতই আছে এখন পর্যন্ত, যদিও তাদের ওপর ভারতীয় বিমানবাহিনী খানিক সময় পরপর বোমা নিক্ষেপ করছে। আমি যা জানতে পেরেছি তা তাদের জানালাম এবং উত্তরে জানলাম, তারাও একটু আগেই একই উত্স থেকে সেই খবর পেয়েছে। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। তাদের কি থামানোর কোনোই উপায় নেই? হিসাব করে দেখা গেল, ভারতীয় বাহিনীর রাজধানী পৌঁছতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। তাদের আক্রমণ ঠেকানোর সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার সেখানে সৈন্য পাঠানোর কোনো ব্যবস্থাও নেই।
আমার কাছে তখন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। বিবিনগর থেকে সোজা অসুরক্ষিত পথে তারা রাজধানী পৌঁছে যাবে এবং এখন তাদের থামানোর জন্য করারও কিছু নেই। আমি হাতেমুখে পানি নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন থেকে কিছু আয়াত পাঠ করে পোশাক পরিধান করে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখন খবর পেলাম, সেনাবাহিনী প্রধান এসে পৌঁছে গেছেন। আর্মি কমান্ডারের জন্য কফি পাঠানোর নির্দেশ দিলাম। জানতে পারলাম, তিনি পশ্চিমে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে সোজা আমার বাসভবনে চলে এসেছেন। তাকে দেখে খুব ক্লান্ত ও ভীত মনে হচ্ছিল। তিনি জানালেন, আমার কথামত তিনি পরিদর্শন করে দেখেছেন। জানতে পেরেছেন, সেখানকার সৈন্যরা ক্লান্ত এবং তাদের মধ্যে তেমন কোনো শৃঙ্খলা নেই। সবকিছু বিবেচনা করে তিনি বললেন, ওই স্থানে কোনো হামলা হলে তারা সামাল দিতে পারবে না। তিনি আরও জানালেন, দিনের শেষে ভারতীয় বাহিনী এখানে পৌঁছে যাবে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে। সুতরাং যেটাই হোক, রাজনৈতিক কোনো সমঝোতায় আসতে হবে।
আমি স্থির চিত্তে তার কথা শুনলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পূর্ব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনো সংবাদ তার কাছে আছে কিনা এবং তিনি ‘না’ জবাব দিলেন। তাকে জানালাম রেলওয়ে চিফের কথা। তিনি শুনে আশ্চর্য হলেন এবং সমাধানে এলেন যে, ভারতীয় বাহিনী নিশ্চয়ই কোনোভাবে নাকরাকালে অবস্থিত বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি জানালেন, যদি তাই হয় তবে দুপুরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী রাজধানীতে এসে উপস্থিত হবে। তারপর কী হবে তা চিন্তা করাও ভয়ের।
আমি শাহ্ মনজিলে আমার ব্যক্তিগত অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জানতে পারলাম মুসতাক আহমেদ গোপন তথ্য পাঠিয়েছেন। তথ্য অবশ্যই প্যারিসে কী চলছে তা নিয়েই হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত বৈঠক শেষ পর্যন্ত ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে বসে। বৈঠকটি ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্যার আলেকজান্ডার কাডোগানের সভাপতিত্বে আয়োজিত হয়। বৈঠকে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, হায়দারাবাদের বিষয়টি বৈঠকে আলোচিত হবে কিনা। এটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। কারণ কিছু টেকনিক্যাল কারণে বিষয়টি বাতিলও হতে পারতো। চীনের প্রতিনিধি জিয়াং, যিনি কিনা পরিষদের একজন স্থায়ী সদস্য, তিনি প্রস্তাব রাখলেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনার তারিখ পিছিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর রাখার জন্য। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে কোনো মতামত তার সরকার এখনও তাকে দেয়নি। স্যার আলেকজান্ডার কাডোগান তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। বললেন, এটি একটি জরুরি বিষয়। সেহেতু এ বিষয় নিয়ে আমরা এগোব কি-না তা নিয়ে অন্ততপক্ষে সময় অপচয় করা উচিত নয়। ফ্রান্সের প্রতিনিধি পারোদি সভাপতির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করলেন। বেলজিয়াম দাবি করল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একদিন পেছানোর জন্য। জনাব মালিক (ইউএসএসআর) সভাপতির কাছ থেকে ১৯৪৭-এর ভারত স্বাধীনতা আইনের আলোকে হায়দারাবাদ বিষয়ক তথ্য এবং সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার অনুরোধ করলেন। যেহেতু তিনি যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি, তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে যত সম্ভব তিনি তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন, যখন উপযুক্ত সময় হবে। জেসোপ (ইউএসএ) বললেন, তিনি বিষয়টি পরিষদে আলোচনায় আনার পক্ষে। জনাব আরস (আর্জেন্টিনা) তার সঙ্গে শক্তভাবে একমত হলেন। বললেন, যখন একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেখানে নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে তখন জাতিসংঘ তাদের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে চলতে পারে না। কিন্তু আলাপ-আলোচনার পর চীনের প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণ করা হলো এবং যেহেতু চীন বাদে কেউ তাতে সমর্থন করছিল না, অতএব বাতিল হয়ে গেল। এবার হায়দারাবাদের বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হবে কি-না সে বিষয়ে ভোট হলো। আলোচনার পক্ষে ৮টি এবং বাতিলের পক্ষে ৩টি ভোট পড়ল। এরপর হায়দারাবাদের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচিত বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা পেল। সভাপতি আমন্ত্রণ জানালেন হায়দারাবাদের প্রতিনিধি মইন নেওয়াজ জঙ্গকে তার কেস তুলে ধরার জন্য। মইন নেওয়াজ জঙ্গ জোরদারভাবে তার বক্তব্য পেশ করলেন। তার বক্তব্যে তিনি বললেন যাতে নিরাপত্তা পরিষদ সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং রক্তক্ষয় থামিয়ে তার দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। কাজটি এমনভাবে সম্পাদন করে যেন তা হয় স্থায়ী। এবার এলো ভারতের পক্ষে বলার জন্য রামসোয়ামি সুহলির পালা। আক্রমণকারী পক্ষ হিসেবে তার আসলে বলার তেমন কিছুই ছিল না। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে হায়দারাবাদের কেস উপস্থাপনের বিষয়টি নিয়েই টানাটানি করলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি প্রমাণ উপস্থাপন করবেন যে হায়দারাবাদ কখনোই আসলে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না।
দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পর সভাপতি বৈঠক গুটিয়ে নিলেন। সব সদস্যকে বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য আদেশ করে দ্বিতীয় বৈঠকে বসার দিন ঠিক করলেন ২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। তাদের মতামত উপস্থাপনের জন্য বললেন সেই দিন। এই একটি সিদ্ধান্ত হায়দারাবাদকে শেষ করে দিল।
নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যদিও সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল, বিষয়টি সমাধানের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বরে পিছিয়ে দেয়া একটি তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করল। হায়দারাবাদের কর্তৃপক্ষ জানতো যে, ২০ সেপ্টেম্বর বেশি দেরি হয়ে যায়। সেই লক্ষ্যে তারা সম্পূর্ণভাবে চেষ্টা করল, প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বৈঠকটি এগিয়ে আনার অনুরোধ করলো। স্যার আলেকজান্ডার কাডোগান বললেন, চাইলেও এটা শনিবার ১৮ সেপ্টেম্বরে আনা সম্ভব হবে না। অস্ত্র সংবরণের প্রস্তাব নিয়ে সব প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করা হলো এবং চীন বাদে বাকি সব সদস্য তার পক্ষে মত দিল। যদিও রাশিয়ার এ বিষয়ে কোনো কিছু বলার ছিল না। পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে মোড় নেবে, এখন শুধু যদি হায়দারাবাদ ভারতকে সেই সময় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত ভারতীয় আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা হায়দারাবাদ সেনাবাহিনীর ছিল না।
সবকিছু বিবেচনায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তাত্পর্য এই মুহূর্তে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে অক্ষম। অন্যদিকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, রাজধানীর ত্রিশ মাইলের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশ করে ফেলেছে। আক্রমণের নির্দেশে তারা যদি রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসে, তবে সাধারণ জনগণের রক্তক্ষয়ের বন্যায় দেশের মাটি প্লাবিত হবে। ভারতীয় বাহিনীর গণহত্যার প্রবণতা আগেই বোঝা গেছে যখন তারা ওসমানাবাদ, কালিয়ানি, বিদর এবং আরও অনেক শহরের নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে হত্যা করেছিল। তাদের মূল ক্ষোভ ছিল ওইসব এলাকার মুসলিম জনবসতির প্রতি। এরই মধ্যে শহরগুলোতে যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় তবে হতাহতের মাত্রা কোথায় গিয়ে উঠবে তা চিন্তা করাও কষ্টকর। আমি আর সময় অপচয় করতে পারবো না। হয়তোবা নিজাম পারবেন ম্যাসাকার থামাতে। আমি ঠিক করে ফেললাম, আমি পদত্যাগ করবো এবং আমার মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও পদত্যাগ করার জন্য মতামত দিলাম।
আর্মি কমান্ডারের সঙ্গে কাজ শেষে আমি শাহ মনজিলে চলে গেলাম। সেখানে মুসতাক আহমেদের আরও কিছু গোপন তথ্য ডিকোড করা হচ্ছিল। তার মধ্যে একটি মেসেজে তিনি পাকিস্তানি নেতাদের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন যে তারা চায় আমি যেন দ্রুত হায়দারাবাদ ত্যাগ করি, যাতে ভারতীয় বাহিনী আমাকে পাকড়াও করতে সক্ষম না হয়। সেখানে প্যারিসের নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ক আরও কিছু তথ্য ছিল। আমি সেদিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে মন্ত্রিসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডাকলাম। কাসেম রিজভী আমার পরিস্থিতি জানার জন্য ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আমি তাকে জানালাম, পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি তাকে স্থির চিত্তে সবকিছু মোকাবিলার উপদেশ দিলাম এবং সাম্প্রদায়িক কোনো দাঙ্গা বা এরূপ কিছু এড়িয়ে চলার জন্য বললাম। তিনি আমাকে জানালেন, যুদ্ধ শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হওয়ার কোনো ধরনের আলামত পাওয়া যায়নি। এমনটি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এই বিপদের ভাগিদার হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই। আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করলাম। তাকে জানালাম এখনই সময় ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক একতাকে বড় করে দেখার।
সকাল ৮টার দিকে নিজামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হলো। তারও কিছুক্ষণ আগে তিনি আর্মি কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আমি তাকে প্যারিসে কী হচ্ছে তা খুলে বললাম। নিরাপত্তা পরিষদ এখন কীইবা করবে, যেহেতু তারা গোলাগুলি বন্ধ করার বিষয়ে একটি প্রস্তাবও পাস করাতে পারেনি। আলোচনা করে কী বা লাভ হবে। বললেন নিজাম, এত লোক মারা গেল, এত রক্তক্ষয় হলো, এখন কাদের পক্ষে তারা রায় দিতে চাচ্ছে? আর কিছু সময়ের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী তাদের অস্ত্রহাতে হাজির হবে, আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হবে? আমি কি বুঝছি না যে যুদ্ধরত অবস্থায় ভারতীয় বাহিনী যদি রাজধানীতে প্রবেশ করে, তবে কী পরিমাণ হতাহতের খবর আসবে, কী পরিমাণ রক্তক্ষয় ঘটবে! সেসব হতভাগ্যের কথা কি আমি জানি না, পূর্বে যাদের শহরে ভারতীয় বাহিনী হানা দিয়েছিল? আমি উত্তরে নিজামকে বললাম, হ্যাঁ, আমি জানি। যতটুকু দরকার আমি ততটুকু জানি এবং আমি তার চেয়েও বেশিই জানি। কিন্তু এত মৃত্যু সত্ত্বেও স্বাধীনতাই আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আমি নিজামকে জানালাম, তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলছেন আমি তা বুঝি এবং আমি তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। আমি জানালাম যে সকালেই আমি আমার পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং মন্ত্রিসভার সবাইকেও একই উপদেশ দিয়েছি। এখন পর্যন্ত যা বুঝছি, তারা সবাই আমার কথা মান্য করবে।
মন্ত্রিসভার সব মন্ত্রী এবং সিনিয়র সেক্রেটারিরা সবাই শাহ মনজিলে একত্রিত হয়েছিলেন। অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি পৌঁছেই তাদের সঙ্গে একত্রে সব কাজ শুরু করে দিলাম। সব ঘটনা তাদের খুলে বললাম। বর্তমান পরিস্থিতির অবস্থা তুলে ধরলাম। নিজামের মতামত তাদের জানালাম এবং এও জানালাম যে, নিজাম চান হয় সব দায়িত্ব তার নিজের হাতে তুলে নেবেন অথবা সব দায়িত্ব পরিহার করবেন এবং সেই মর্মে ঘোষণা দেবেন। আমি সবাইকে বললাম, তারা পরিস্থিতি যেন খুব ভালো করে বিবেচনা করে দেখে। এরপর তাদের মতামত স্পষ্টভাবে নির্ভয়ে প্রত্যেকে যেন আমাকে জানায়। কিছু সময়ের জন্য রুমটি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। উপ-প্রধানমন্ত্রী পিঙ্গেল রাধা রেড্ডী প্রথম নিস্তব্ধতাকে ভাঙলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের খাতিরে নিজের জান দিতেও প্রস্তুত। তিনি বললেন, নিজাম যদি মনে করেন যে কোনোভাবে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন, তবে তিনি বাধ্য সেই উপদেশ মেনে নিতে। এরপর তিনি তার পরিবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন। তিনি আরও বললেন, আমার দায়িত্বাধীন অবস্থায় সব সরকারি কর্মকর্তা এবং নাগরিক তাদের সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা দিয়ে দেশরক্ষার স্বার্থে কাজ করেছে এবং নিজেদের কখনোই দুর্বল মনে করেনি। তিনি আরও বললেন, যদিও একা যুদ্ধ করে বিশাল ভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের পরাজয় হয়েছে, আমরা প্রত্যেকে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশপ্রেমের জন্য যা করেছি, সবই ছিল সঠিক। এখানে অনুতাপের কিছুই নেই। তিনি বললেন, হয়তোবা এটাই তার শেষ বক্তব্য। হয়তো কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু সেই মৃত্যু কোনোভাবেই সম্মানহীন মৃত্যু নয় এবং তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, যদি আমি পদত্যাগ করি, তিনিও ধারাবাহিকভাবে পদত্যাগ করবেন।
তার বক্তব্য ছোট হলেও খুব তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও সংক্ষেপে একই রকম বক্তব্য পেশ করলেন। নিজামের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে একটি লিখিত দলিল তৈরি করা হলো, যেখানে বলা হলো যে মন্ত্রিসভার সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে দেশ রক্ষার্থে। কিন্তু ভারতীয় পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। তাই আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়া হলো এবং এই মর্মে প্রত্যেকে পদত্যাগপত্র নিজামের কাছে জমা দিচ্ছি। আমার তত্ত্বাবধানে পত্রটি নিজামের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়েই দেখলাম, কিছু স্টাফ অফিসার আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা আমাকে জানালেন যে ভারতীয় বাহিনীর গন্তব্য বের করার উদ্দেশ্যে যারা যাত্রা করেছিল তারা বিবিনগর এবং বিবিনগর পেরিয়ে আরও দূর পর্যন্ত খুঁজেও ভারতীয় বাহিনীর কোনো অস্তিত্ব পায়নি। দেখা যাচ্ছে, রেলওয়ে থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা ছিল ভুল। তারা এও জানাল যে, শুধু বিমান থেকে অনবরত বোমা নিক্ষেপণ ছাড়া পূর্ব-পশ্চিম যুদ্ধক্ষেত্রেও ভারতীয় বাহিনীর কোনো অগ্রসর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু পড়তে লাগল। যখন আমি তাদের জানালাম যে সরকার পদত্যাগ করেছে এবং নিজাম কিছু সময়ের মধ্যেই শান্তির বাণী ঘোষণা করবেন। ‘কিন্তু কেন স্যার’—তারা বলে উঠলো—‘আমরা এখন পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম। তাদের আক্রমণ আরও কিছু সময় আমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারবো।’ ‘সাব্বাস’, আমি তাদের বললাম। হয়তোবা আমরা শিগগির মারা যাব, কিন্তু আমাদের বিজয়ী চেতনা চিরকাল ধরে বেঁচে থাকবে।
নিজামের কাছ থেকে একটি জরুরি ফরমায়েশ এলো এবং আমাকে দ্রুত দেখা করতে বলা হলো। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন দেখলাম নিজাম পুলিশ প্রধান এবং আর্মি কমান্ডারকে নিয়ে আলোচনা করছেন একটি নতুন সরকার গড়ার বিষয়ে। তিনি ততক্ষণে মুনসির কাছে খবরটি পাঠিয়ে দিয়েছেন যে, আমার সরকার পদত্যাগ করেছে এবং নতুন সরকার গড়ার জন্য তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিবর্গের পরামর্শ চান। আমি এই বিষয়ক আলোচনাতে অংশগ্রহণ করিনি। আমি বৈঠক শেষে নিজামের সঙ্গে দেখা করলাম। মত দিলাম, এটা আশা করা উচিত নয় যে এত সহজভাবে সব হয়ে যাবে। আরও উপদেশ দিলাম, অফিসে রক্ষিত গোপনীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস করে ফেলতে। তিনি আমার মত নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলেন এবং তারপর তার পার্সোনাল সেক্রেটারিকে আদেশ দিলেন অফিস থেকে সব গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং ফাইল বের করে ধ্বংস করে ফেলতে।
আমি শাহ মনজিলে ফিরে গেলাম এবং সেখানে সব গোপনীয় দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং বিশেষ করে গোপন তথ্য ডিকোড করার যে কি-গুলো ছিল তা সবই ধ্বংস করে ফেলার আদেশ দিলাম। এরপর মুসতাক আহমেদের কাছে একটি মেসেজ পাঠালাম। এটিই ছিল তার কাছে পাঠানো শেষ মেসেজ। মেসেজে তাকে জানালাম, ভারতের সামরিক শক্তির কাছে আমরা পরাজিত এবং নিজামের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেছি। এটিই হয়তো আমার শেষ মেসেজ। হয়তোবা কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবো। তাকে এও বললাম, আমরা যদি নাও থাকি, তিনি যেন আমাদের পতাকা ওড়াতেই থাকেন। সর্বশক্তি দিয়ে যেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি তার যুদ্ধ চালিয়ে যান।
নিজামের কাছ থেকে ফেরার সময় আমি মুনসিকে কল দিয়েছিলাম। তিনি ভারতের সঙ্গে ফের টেলিফোন, বেতার এবং টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। আমি জেনে অবাক হয়েছিলাম, নিজামের মতোই তিনিও আবার সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে তার স্টাফদের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন। এমন একটি সরকার যার প্রধান উপদেষ্টা হবেন তিনি। আমি মুনসিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অনেক মিথ্যা প্রচার থাকলেও বাস্তবে কোথাও হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা হায়দারাবাদে ঘটেনি। আমি তার কাছে আশা রেখে অনুরোধ করেছিলাম, আগত আর্মি কমান্ডারদের নিয়ে ভালো কাজে লাগাতে। যেমনটি পূর্ববর্তী শহরগুলোতে করেছে, সেখানে যেমন গণহত্যা চালানো হয়েছে তা যেন এখানে না করে। আমার কথা তার মর্মকে স্পর্শ করেছিল বলে মনে হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন যেন দখলদার বাহিনী সাধারণ জনগণের ওপর কোনো হত্যাযজ্ঞ না চালায়।
নিজামের একটি টেলিফোন কলে রাখা অনুরোধের কারণে আমি তার সঙ্গে একত্রে শুক্রবারের নামাজ আদায়ের জন্য গণউদ্যানে অবস্থিত সুন্দর ছোট মসজিদটিতে হাজির হই। নামাজ শেষে নিজাম আমার কাছে কিছু সময় চেয়ে নিলেন। আমি রাজি হলাম। পরে আমি সেখান থেকে শাহ মনজিলে চলে আসি, সেখানে সব গোপন নথিপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে কিনা তা তদারকি করে দেখার জন্য।
সেদিন বিকালের দিকে আমি একবার হায়দারাবাদ রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলাম হায়দারাবাদের জনগণের উদ্দেশে একটি মেসেজ বেতারে ঘোষণার জন্য। খুবই সংক্ষেপে আমার বক্তব্যে আমি বলি—হায়দারাবাদের এখন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। স্বাধীনতা রক্ষায় সফল না হওয়ায় সরকার পদত্যাগ করেছে। আমি আরও বললাম, এই বিপদে প্রত্যেক নারী-পুরুষ এবং শিশু যেন সাহস না হারায়। ধৈর্যচ্যুত না হয়। আমি তাদের উপদেশ দিলাম এক নতুন শাসন ব্যবস্থার জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে। এমন এক শাসন ব্যবস্থার জন্য, যার সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারার কোনো মিল নেই। আমি তাদের বিশেষভাবে নজর দিতে বললাম যেন কোথাও একটিও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ না হয়। আমরা সব সময় মিলেমিশে যেভাবে চলেছি, তা ভুলে যেন নিজের জাতকে এমন অমঙ্গলজনক কাজে রক্তাক্ত না করি। আমি তাদের বললাম খোদার ওপর বিশ্বাস রাখতে এবং তাদেরকে তারই হাতে ছেড়ে দিলাম।
ফেরার পথে আমি লক্ষ্য করলাম, পথে দোকানে-বাজারে যেখানেই রেডিও আছে সবগুলোরই ভলিউম বাড়ানো। সেখানে মানুষ ভিড় জমিয়েছে। সবাই আমার বক্তব্য শুনেছে। তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল সমগ্র হায়দারাবাদ যেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই কেমন যেন একটি ছোট পাথরের মতো হয়ে গেছে। দৃশ্যটি দেখে নিজের অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি শাহ মনজিলের পথে রওনার সময় কাসেম রিজভীকে টেলিফোনে একটি দায়িত্ব দিলাম। তাকে বললাম যেন রেডিওতে তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার জন্য, শান্তি বজায় রাখার জন্য। প্রথমে যদিও তাকে অনিচ্ছুক দেখাচ্ছিল, পরে তিনি এমন এক ভাষণ দেন রেডিওতে যা ছিল চিত্তাকর্ষক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাষণে তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, কেউ যেন শান্তি-শৃংখলা এবং আইন ভঙ্গ না করে এবং সাম্প্রদায়িক গোলযোগে না জড়ায়।
আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যেসব গোলাবারুদ এবং অস্ত্র ছিল তা ধ্বংস করে ফেলা ছিল আমার জন্য একটি চিন্তার বিষয়। আমি ক্ষমতা ছাড়ার আগে সাধারণভাবেই একটি আদেশ দিয়েছিলাম এ বিষয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, আমি ক্ষমতায় না থাকা সত্ত্বেও আমার আদেশ সব কর্মচারী ঠিকমতই পালন করলো।
তখন একটি ছোট ঘটনা আমার মর্মকে স্পর্শ করেছিল। আবদুর রহিম নামে আমার মন্ত্রিসভার এক সদস্য আমার কাছে ছুটে এসে করুণভাবে একটি আবদার রেখেছিলেন। বলেছিলেন যেন কোনোভাবে কাসেম রিজভীকে আমি পাকিস্তান বা অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করি। তিনি বলেছিলেন, আমি জানি কিছু সময়ের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী এখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের সবাইকে গুলি করে মারবে। কিন্তু তারা কাসেম রিজভীকে কেটে টুকরো টুকরো করে মারবে। তার দেহাবশেষ শকুনের ভক্ষণের জন্য দেবে। আমি তার পরার্থপরতা এবং আন্তরিকতা দেখে আন্দোলিত হয়েছিলাম। আমি আর্মি কমান্ডারকে ফোন করি এবং তাকে জিজ্ঞাসা করি, কাসেম রিজভীকে কোনোভাবে বিমানে করে পাঠিয়ে দেয়া যায় কিনা। কিন্তু দুঃখজনক যে তিনি বলেন, এটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ ভারতীয় বিমান সর্বত্র পাহারা দিচ্ছে এবং আমাদের বিমান উড়তে দেখলেই তাকে ভূপাতিত করবে।
এরপর আমি ঠিক করলাম নিজামের সঙ্গে সাক্ষাত্ করা কমিয়ে আনব। কিন্তু কাজ হলো না। দেখা গেল, নিজাম নিজেই বারবার আমাকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ডাকছেন। এমনি এক সাক্ষাত্কারে আমি উপস্থিত। উপস্থিত হয়ে লক্ষ্য করলাম, আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব অর্থাত্ তরবারি কে তুলে দেবে বিপক্ষের আর্মি কমান্ডারের হাতে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। আর্মি কমান্ডার মনে করছিলেন, এই কাজের জন্য তিনিই হলেন সঠিক ব্যক্তি। কিন্তু বৈঠকে উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অনেকেই মনে করছিলেন, এই দায়িত্ব বহন করা উচিত রাজকুমারের (বিদরের রাজকুমার); যিনি কিন্তু আনুষ্ঠানিক কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন। নিজাম এ ব্যাপারে এতটাই দুঃখিত ছিলেন যে তিনি এ বিষয়ে আমার মতামতটুকুও চাইলেন না।
সেদিন সন্ধ্যাতেই মুনসি একটি কূটনৈতিক এবং বুদ্ধিমান চাল চাললেন। তিনি নিজামকে বাধ্য করেন রেডিওতে নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্দেশ করে এই মর্মে বক্তব্য পেশ করতে যে, এটা তার আদেশ, যেন হায়দারাবাদের প্রতিনিধিবর্গ তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। এরপর মুনসি নিজেই একটি বক্তব্য রেডিওতে প্রদান করে। দুটি বক্তব্য মিলে এমন দাঁড়ায় যে, আগের সব সরকার ছিল বিপথে এবং বিশেষ করে এই শেষ সরকার তাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট। এখন সব ভুল সংশোধনের সময়। এই মর্মে হায়দারাবাদ এখন ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে আমি যখন সুযোগ পাই, নিজামকে জিজ্ঞাসা করি যে পরামর্শ মোতাবেক সব গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিল ধ্বংস করা হয়েছে কিনা। নিজাম আমাকে নিশ্চয়তা দেন, তা সবই হয়েছে। পরে ১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে আর্মি কমান্ডার এবং তার স্টাফরা জিপে করে মেজর জেনারেল জয়ন্ত নারায়ণ চৌধুরীকে বলারামের বাসভবনে নিয়ে আসেন। চৌধুরী ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বে। নিজাম সেখানে তার নিজের পক্ষের লোক পাঠালেন। যাদের মধ্যে ছিল জুলকাদের জঙ্গ, আবুল হাসান সাঈদ আলী, আলী ইয়াভোর জঙ্গ এবং আরও এক কি দু’জন। তারা সেখানে নিজামের পক্ষ থেকে তাকে শুভেচ্ছা জানায় এবং নিজাম মুনসির মতামত গ্রহণে নতুন যে সরকার গঠনের নকশা প্রস্তুত করেছেন তা পেশ করেন। যেন তা তার গ্রহণযোগ্যতা পায়। পরে বিকালে আবারও নিজামের ডাকে যখন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই, আমাদের সাক্ষাতের মাঝে নিজামের পক্ষ থেকে পাঠানো দূতরা ফিরে আসেন। তাদের চেহারা মলিন সবুজ বর্ণ ধারণ করেছিল। তারা জানান দিল যে, জেনারেল চৌধুরী তাদের সরকার গঠনের প্রস্তাব নাকচ করেছে এবং নিজামের এ বিষয়ক সব মতামত তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন বলে বলেছেন। তারা জানান দিলেন যে, তিনি বলেছেন তিনি মার্শাল ল কায়েম করবেন। সামরিক শাসনে দেশ চলবে এবং তিনি নেবেন শাসনভার। ‘কী! কী!’ নিজাম চিত্কার করে উঠলেন। এরপর তিনি আমার দিকে ফিরে জোর কণ্ঠে বললেন—‘কিন্তু লায়েক আলী, মুনসির সঙ্গে তো আমার এমন কথা হয়নি।’ ‘আমি বুঝতে পারছি’—জবাব দিলাম আমি। কিন্তু তিনি আমার কথার কোনো পাল্টা উত্তর দিলেন না। আমি বুঝতে পারলাম, এই বৈঠকে আমার উপস্থিতি কাম্য নয়। তাই আমি নিজামের অনুমতি চাইলাম সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। নিজাম আমাকে অনুমতি দিলেন। তবে বললেন যেন পরদিন সকালে আমি তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। কিন্তু এমনটি আর কখনও হয়ে ওঠেনি।
বাড়ি ফিরে আমি জানতে পারলাম, ভারতীয়রা ১৯ তারিখ দুপুরে পশ্চিম থেকে এবং বিকালে পূর্ব থেকে রাজধানীতে প্রবেশের পরিকল্পনা করেছে। পরে সন্ধ্যায় একজন বার্তাবাহক পুলিশ চিফের কাছ থেকে আমার জন্য একটি চিঠি নিয়ে আসে। এটি ছিল মূলত মিলিটারি গভর্নরের পক্ষ থেকে। তিনি আমাকে আদেশ করেছেন যেন আমি ঘর থেকে বের না হই। আমি এখন একজন গৃহবন্দি। আমি তত্ক্ষণাত্ ব্যবস্থা করে দেই যেন আমার স্ত্রী, বোন এবং সন্তানরা নিরাপদে সেখান থেকে দূরে কোনো বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেয়। অন্ততপক্ষে আমার জান নেয়ার দৃশ্য তাদের যেন প্রত্যক্ষ করতে না হয়। তাছাড়াও আমার পরিবারবর্গের কাউকে যেন তারা লাঞ্ছিত করতে না পারে, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আমার সঙ্গে আর কেউই রইল না। শুধু আমার বাল্যকালের আরবীয় বংশোদ্ভূত একজন শিক্ষক বাদে, যিনি কিনা ছোটবেলা থেকে আমার ওপর নজরদারি করে এসেছেন। পুলিশ চিফের কল এলো এবং তিনি আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তার দ্বারা এমন কাজ করানো হচ্ছে তার জন্য তিনি লজ্জিত। আমি তাকে বললাম, এখানে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমি ব্যাপারটি বুঝতে পারছি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাসেম রিজভীর কী হবে। তিনি আমাকে জানালেন, পরদিন সকালেই তাকে উঠিয়ে আনা হবে।
কিছুক্ষণ পর কাসেম রিজভীর তরফ থেকে একটি ফোন আসে। তাকে সব সময়ের মতোই প্রফুল্ল শোনাচ্ছিল। তিনি পরদিন সকালে আমার সঙ্গে নাস্তা করার অনুমতি চাইলেন। যেমনটা আগেও বহুবার তিনি আমার সঙ্গে করতেন। আমি তাকে কী উত্তর দেব বুঝে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ আমি তাকে জানালাম, আমার বাড়িতে তিনি সব সময়ই স্বাগত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি জানতেন না তার সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে।
আমাকে একা রেখে দূরে থাকা আমার পরিবারের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছিল। পরদিন সকালে হঠাত্ তারা বাসায় উপস্থিত হলো। তারাও আমার পরিণতি তাদের নিজেদের জন্য বরণ করে নিয়েছে। কী করে তারা এখানে আবার এসে পৌঁছাতে পেরেছে তা ছিল বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। আমার বাসার সব টেলিফোনের লাইন কেটে ফেলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি কী হচ্ছে তা সম্পর্কে মোটামুটি খবর পেতে থাকি। জানতে পারলাম, পূর্ব এবং পশ্চিম থেকে সেনাবাহিনীরা প্রবেশ করে বলরাম মিলিটারি স্টেশনের দিকে মার্চ করে আসছে। যেখানে কিনা ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগের আগে অবস্থান করতো।
সেদিন রাতে একজন লম্বা এবং সুঠামদেহী ভারতীয় সেনা অফিসার আমার বাসায় এলেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। তিনি ছিলেন কর্নেল পদমর্যাদাপ্রাপ্ত। তিনি আমাকে স্পষ্টভাবে কিন্তু ভদ্র ভাষায় বললেন, সকালে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি হেসে তাকে বললাম—‘ফায়ারিং স্কোয়াড কি আমাকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকবে?’ আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটলো। আমি দেখতে পেলাম তার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি আমার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং প্রশ্নের জবাব না দিয়েই সেখান থেকে তাকে যেতে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। হঠাত্ করে এমন খবর শুনে আমার স্ত্রী, বোন এবং সন্তানরা আতঙ্কে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার পরিবার ছিল সাহসী। কিছু সময় পর তারা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। সম্ভবত সেদিন রাতে তারা কেউই ঘুমায়নি। আমি আমার পরিবারের লোকদের সঙ্গে আলাপ, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এবং ঘুম—এসবের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে বেশকিছু সেনাবাহিনীর গাড়ি আমার বাসভবনকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু কেউই প্রবেশ করে না। আমরা দিনের আলো ফুটে সূর্য আরও আলোকিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ রাখছিল। কিছু সময় পর সেনা গাড়িবহর ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে চলে গেল। আমরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু কোনো ঘটনাই ঘটলো না। হয়তোবা নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের কারণে এনমটি হলো। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো। ঘণ্টা থেকে দিন। দিন পেরিয়ে মাস। মাস পেরিয়ে বছর। এ সময়ের মধ্যে আমাকে নিয়ে কিছুই করা হলো না। আমি তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনেও করতে পারছি না, যা কিনা সে সময় ঘটেছিল। তারপর একদিন সৌভাগ্যক্রমে সুযোগ এসে গেল। আমি হায়দারাবাদ ছেড়ে পালালাম। পালিয়ে বাঁচলাম। আমরা অনেকেই বাঁচলাম। কিন্তু চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল স্বাধীন হায়দারাবাদের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। বিলীন হয়ে গেল বৃহত ভারতের মধ্যে।
a_hyesikder@yahoo.com

শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

‘আশরাফিয়া নোবেলপ্রাপ্তি কোচিং সেন্টার’ : ইউনূসবধ কাব্য : বাই হার এক্সপার্ট মিনিস্টারস



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নজিরবিহীন কতগুলো ঘটনা ঘটিয়ে বসে আছে শাসকরা, দেশের বিরোধী দলগুলোর ৩৩ জন নেতাকে একসঙ্গে জেলে পাঠিয়ে স্থাপন করেছে এক আক্কেলগুড়ুম হওয়া দৃষ্টান্ত। জননেতা ইলিয়াস আলীর কোনো খবর দিচ্ছে না সরকার। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখন হিমাগারে। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যার কারণ অনুদ্ঘাটিত। পুলিশের নির্মম নির্যাতনে মারা গেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক আজিজুর রহমান। পুলিশি বর্বরতার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু ও খায়রুল কবির খোকন। মাধবপুরে পাওয়া গেছে ছাত্রদল কর্মীর মাথাকাটা লাশ। তানোরে পাওয়া গেছে যুবক উজ্জ্বলের মৃতদেহ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে মরছে ৩০ জন করে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ। প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে মা-বোনেরা। উল্টোদিকে, জনতার দিকে বীরদর্পে গুলি ছুঁড়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি গিয়াস উদ্দিন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস কেলেঙ্কারির ঐতিহ্যবাহী পথ ধরে আরেক এমপি শামসুল হক চৌধুরীর এপিএসের গুদাম থেকে র্যাব উদ্ধার করেছে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা।
তবুও আমার আজকের বিষয় ইউনূসবধ কাব্যের দ্বিতীয় পর্ব।
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন, দুর্নীতির বদনাম ঘোচাতে পারলে তিনি বিশ্বব্যাংককে বলবেন পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দিতে। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রণব মুখার্জি পুরনো প্রেমের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন তার অফিসে গিয়ে। তারপর ঠাস ঠাস করে বললেন, দলনিরপেক্ষ ফ্রি এবং ফেয়ার ইলেকশন তারা বাংলাদেশে দেখতে চান। বললেন কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়, ভারতের বন্ধুত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে।
এইসব শুনে শুনে এমনিতেই মাথায় বায়ু চড়ছিল আমাদের সরকারের। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের আগমন ও প্রস্থানের পর সরকারের ভেতরকার বায়ু ঊনপঞ্চাশ রকমের টাইফুন সৃষ্টি করেছে। যার লণ্ডভণ্ড তাণ্ডবে এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দেশবাসীর।
সাধু ভাষায় হিলারি বয়ান
বাংলা সাহিত্যে ‘মঙ্গল কাব্য’ নামে একটি ধারা রহিয়াছে। দেবীদের তুষ্ট করিবার জন্য, আরাধনার অংশ হিসাবে বাংলাভাষী কবিরা ‘মঙ্গল কাব্য’ লিখিয়া দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করিতেন। আপনার জন্যও ‘অন্নদা মঙ্গল’, ‘চণ্ডী মঙ্গল’, ‘মনসা মঙ্গল’ জাতীয় ‘হিলারি মঙ্গল’ লিখিয়া পুণ্যলাভের খায়েশ আমার ছিল। কারণ মানবকুলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই ব্যক্তির একজন আপনি। আবার আপনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর মাতাও বটে। আপনাকে সকাল-বিকাল কদমবুচি না করিলে ক্ষমতায় থাকাও যায় না, ক্ষমতায় আরোহণও করা যায় না।
কিন্তু এ আপনি কী করিলেন? জগতের আগুন নির্বাপণের বদলে আপনি আমাদের শাসকদের দিলের আগুন ৭০ গুণ বাড়াইয়া দিয়া গেলেন। সেই আগুনে আমাদের শাসকদের চক্ষু অগ্নিবর্ণ ধারণ করিয়া সকল কিছু সংহার করিতে এখন উদ্যত। মাঝখানে পড়িয়া নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবন দ্বিতীয়বারের মতো শিক কাবাব হইবার উপক্রম হইয়াছে।
মাতঃ হিলারি, হে মহামহিম মার্কিনি দেবী, আপনি বিমানবন্দরে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে ৫০ মিনিট ঠা ঠা রৌদ্রের মধ্যে খাড়া করাইয়া রাখিলেন। দীপু মনি রৌদ্রে পুড়িয়া ঘামে ভিজিয়া যখন জেরবার, সেই সময় আপনি বিমানের বাহিরে আসিলেন। এই কর্মের পর, যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আপনি ইলিয়াস আলী, আমিনুল ইসলাম এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নাম উচ্চারণ করিলেন। ইহার পর আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে ডিনার খাওয়ার দীপু মনির নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় গমন করিলেন। এইখানেই শেষ নহে, ইহার পর তাহার সাথে হাসিয়া হাসিয়া একত্রে ডাবের পানি, জামরুল, পাটিসাপটা পিঠা ইত্যাদি ভক্ষণ করিয়া, ইলিয়াস-কন্যাকে কোলে তুলিয়া ছবি তুলিলেন। পরদিন সকালে শাসকদের না জানাইয়া তরুণ-তরুণীদের সাথে বাংলাদেশী আড্ডা দিলেন। এইখানেই যদি সব সমাপ্ত হইতো তাহা হইলে হয়তো কিছু হইতো না। কিন্তু গরম তপ্ত চুল্লির উপর ঘৃত ঢালিয়া দিয়া আপনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদের সাথে একান্তভাবে ঘরোয়া সাক্ষাত্কারে মিলিত হইলেন। তাহারপর তিনজনে একত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সাফাই গাহিলেন। তাহারপর শাসকদের অষ্টরম্ভা দেখাইয়া আপনি বাংলাদেশ ত্যাগ করিলেন।
মাতঃ, আপনি তো উড়াল দিয়া পগাড় পার হইলেন। পিছনে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল আমাদের আমির উমরাহ এবং উজির সাহেব ও সাহেবানদের সৃজনশীলতা।
তাহাদিগের মধ্যে দৃশ্যমান এইরকম সৃজনশীলতাকে বক্ষে ধারণ করিয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রণয়ন করিয়াছিলেন ‘ইউনূসবধ কাব্য’-এর প্রথম পর্ব। তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া তাহার পারিষদবর্গ এবার কোমরে গামছা বাঁধিয়া ‘ইউনূসবধ কাব্য দ্বিতীয় পর্ব’ রচনার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন।
মাতঃ হিলারি, এ আপনি কী করিলেন?
নস্ট্রাডুমাস হইতে সাজেদা চৌধুরী
দিনটি ছিল ৮ মে ২০১২। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর ৭৭তম জন্মদিন। ওইদিন আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতে তার মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে রুহানি ফয়েজ হাসিল হলো। তিনি পৃথিবীখ্যাত ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডুমাস ও শাহ নেয়ামতুল্লাহর মতো দিব্যজ্ঞান লাভ করে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন।
ওইদিন গুলশানের নিজ বাসভবনে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজ অলৌকিক ক্ষমতা লাভের প্রথম কিস্তি জাহির করে বললেন, খালেদা জিয়া কোনোদিন রাজনীতি করেননি। তার স্বামী কিছু সময় ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। না, এটা তার ভবিষ্যদ্বাণী নয়, এটা হলো ‘অতীত কালচার’। তবে এই অতীত কালচার বয়ান করার সময় তিনি অবশ্য সঙ্গত কারণেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে মরহুম শেখ মুজিব কর্তৃক গণতন্ত্রবধের অনন্য কীর্তি চেপে গেছেন। যেমন চেপে গেছেন ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার কালো দিনটির কথা।
থাক সে কথা। তার ভবিষ্যদ্ববাণী নিয়ে কথা বলি। তিনি ওই অনুষ্ঠানেই ভবিষ্যদ্বাণী করে জাতিকে শিহরিত করে বলেছেন, ‘ড. ইউনূস ক্ষণস্থায়ী। এরা কিছুদিনের জন্য আসে আবার চলে যায়। একদিন হারিয়ে যাবে।’ কে কে ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবেন না, সে কথা তিনি না বললেও তার গুণমুগ্ধরা বলছেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, মাহবুব উল আলম হানিফ, দিলীপ বড়ুয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, আসলাম সানী, শামীম ওসমান, জয়নাল হাজারী, সৈয়দ আবুল হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ফারুক খান প্রমুখ ব্যক্তি হয়তো ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। তারা হারিয়ে যাবেন না।
আমরা জানি না, শ্রদ্ধেয়া সাজেদা চৌধুরী এরপর কোনো ‘ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান কেন্দ্র’ খুলবেন কিনা। খুললে অবশ্য ফুটপাতের আলতু-ফালতুসহ সব জ্যোতিষীর ভাত মারা যাবে। তবে সাইড বিজনেস হিসেবে বিষয়টা মন্দ নয়।
আবুল মালের ‘রাবিশ তত্ত্ব’
আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় থেকে ‘স্বৈরাচারের দালাল’ বলে বিস্তর গালি খেয়েছেন তখন তার মুখ দিয়ে ‘উহ্’ শব্দটি বের হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে আওয়ামী লীগের তালেবর তারপর মন্ত্রীবর হওয়ার পর থেকেই তার জবান খুলে গেছে। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। এখন সেই খোলা জবান দিয়ে তিনি হামেশাই একে ওকে গালমন্দ করছেন। এর মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় গালিটি হলো ‘রাবিশ’।
এই গালি তিনি প্রথম চালু করেন শেয়ারবাজারে সর্বস্বান্ত হওয়া ৩৩ লাখ অসহায় লগ্নিকারীর বিরুদ্ধে। সরকারের অব্যবস্থা ও অপব্যবস্থায় যারা রাতারাতি সব কিছু হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হয়েছিল, সেই শেয়ার ব্যবসায়ীরা তার দৃষ্টিতে ছিল টোটালি ‘রাবিশ’। তাদের তিনি জুয়াড়ি বলতেও ছাড়েননি।
বোধ করি এই গালমন্দ বাধাগ্রস্ত না হওয়ার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এবার এই গালিবর্ষণ করেছেন ড. ইউনূসের ওপর। বলেছেন ড. ইউনূসের বক্তব্য ‘রাবিশ’। এরপর ‘সরি’ বলে আবার জোর দেন তিনি, যা বলেছেন এটাই ঠিক।
এক হাত দেখিয়েছেন তিনি হিলারি ক্লিনটনকেও। কারণ হিলারি বলে গেছেন, ‘আমি মুহাম্মদ ইউনূস ও তার কাজকে সম্মান করি। আমি আশা করি, তার কাজ অব্যাহত থাকবে এবং সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডে তা ব্যাহত হবে না। যদি হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক।’
আসলে বাংলাদেশ সফরকালে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে হিলারি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলে গেছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিরোধের বিষয়টি আমি ওয়াশিংটন থেকেই নজর রাখছি। আমি শুধু আশা করতে পারি, এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য খর্বিত হয়।’ এরপর ড. ইউনূস নাকি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার কথা বলেছেন।
ব্যস, আর যায় কোথায়? অর্থমন্ত্রী রেগে একেবারে টং। বলে বসলেন, হিলারির বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।
এখন কেউ যদি মুখ ফসকে বলে বসে, সবাইকে ‘রাবিশ’ বলে বলে তিনি নিজে একটা মূর্তিমান ‘রাবিশে’ পরিণত হয়েছেন। তাহলে উপায় কি?
সৈয়দ আশরাফের অভূতপূর্ব আবিষ্কার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের ঋণ কোনোদিন শেষ হওয়ার নয়। তার কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। অভূতপূর্ব দুটি অনন্যসাধারণ আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে অপার আনন্দে ভাসিয়েছেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রাপ্ত পর্যন্ত তার এই আবিষ্কারের আনন্দ ঢেউ খেলে খেলে বেড়াচ্ছে।
তার প্রথম আবিষ্কারের দুটি অংশ। প্রথমাংশে তিনি জ্ঞানতাপস ড. শহীদুল্লাহর চাইতেও দৃঢ়তা নিয়ে ড. ইউনূসের বেসিক সাবজেক্ট অর্থনীতি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘মাইক্রোক্রেডিট করলেন একজন কিন্তু অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পেলেন না। নোবেল পেলেন কোথায়? পেলেন শান্তিতে। কোন যুদ্ধে উনি শান্তি আনলেন? কোন মহাদেশে উনি শান্তি আনছেন?’
অর্থাত্ যুদ্ধ না থামালে শান্তি পুরস্কার পাওয়া যায় না। এই যে আবিষ্কার, এর দ্বিতীয়াংশে আছে আয়ারল্যান্ডের ‘মাদারল্যান্ড পিস’ নামীয় এক সংগঠনের দুই মহিলা নাকি সংগঠন করার দুই মাসের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পান শান্তিতে। তারপর টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দুই মহিলার মধ্যে ঝগড়া বাধে। তিন মাসের মধ্যে এই ঝগড়া আদালতে গড়ায়। শান্তির কর্ম কাবার। দ্বিতীয়াংশের এই আবিষ্কারটিও অসাধারণ। কারণ সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর অনেকেই নোবেল কমিটি ও আয়ারল্যান্ডে যোগাযোগ করে এরকম সংগঠন ও নোবেল পাওয়ার কোনো আলামত খুঁজে পাননি। কিন্তু তাতে কী? তাতে তো এই আবিষ্কারের মর্যাদা খাটো হয়ে যায় না!
সৈয়দ আশরাফের দুই নম্বর আবিষ্কারটি সত্যিকারের আবিষ্কার। আবিষ্কারের বাচ্চা আবিষ্কার। বাঘের বাচ্চা আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি চিরকাল বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। যে পুরস্কার পাওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় মানুষ মুখিয়ে থাকে, সেই নোবেল কীভাবে পাওয়া যায়, তা তিনি আবিষ্কার করে সবাইকে চমত্কৃত, বিস্মিত ও হতভম্ব করে ফেলেছেন। হার্টের জোর যাদের কম তাদের অনেকে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন। এমন একটা সামান্য বিষয় আমরা জানতাম না বলে বিশ্বের দেশে দেশে অনেক জ্ঞানীগুণী টেবিলে, দেয়ালে, ইলেকট্রিকের থাম্বায় মাথা আছড়াচ্ছেন।
এবার তার সেই মহান আবিষ্কারটি তুলে ধরছি। নোবেল কীভাবে আসে তা আমাদের এখানে অনেকেই জানেন মন্তব্য করে বলেছেন, ‘নোবেল কীভাবে দেয়া হয়, কীভাবে আসে, কেন দেয়া হয়—সে বিষয়ে আমারও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। বিশ্বের কিছু দেশ আছে যেখানে গিয়ে চিপস, স্যান্ডউইচ আর হোয়াইট ওয়াইন খেলে জনপ্রিয়তা বাড়ে। সময়মত নোবেল প্রাইজ পাওয়া যায়।’
সৈয়দ আশরাফের এই মহা মহা আবিষ্কারে আমার মতো অনেকেরই হয়তো দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল। কারণ তিনি শুধু আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি। বলেছেন, এ ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতাও আছে। কী আশ্চর্য, আমাদের হাতের কাছে, ঘরের ভেতরে এমন একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক আছেন তা এদ্দিন আমরা জানতেও পারিনি! পোড়া কপাল আর কাকে বলে!
দেশ, জাতি ও বিশ্ব মানবতার পক্ষ থেকে সৈয়দ আশরাফের কাছে আমাদের কাতর অনুরোধ, দোহাই আল্লাহর, এবার দয়া করে জানিয়ে দেন, কোন কোন দেশে গিয়ে চিপস, স্যান্ডউইচ আর সাদা মদ খেলে জনপ্রিয়তা বাড়ে, যা আখেরে জুটিয়ে দেবে নোবেল।
আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, দরখাস্ত—যে আবিষ্কার আপনি করে ফেলেছেন, তা বাংলাদেশের কল্যাণে উত্সর্গ করুন। বিশ্ব মানবতার সেবায় উত্সর্গ করুন। দয়া করে আপনি, ‘নোবেলপ্রাপ্তির সহজ উপায়’ অথবা নিজের নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘আশরাফিয়া নোবেলপ্রাপ্তির কোচিং সেন্টার’ খুলুন। আমরা যে যে দলই করি না কেন, সবাই মিলে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে আপনাকে সেই সেন্টারের ‘প্রিন্সিপাল’-এর চেয়ারে বসিয়ে মানবজনম সার্থক করবো।
আপনার সেই কোচিং সেন্টারে গিয়ে আমরা যারা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য পাগল, উন্মাদ, বেহুঁশ ও বেসামাল হয়ে আছি, তারা কোচিং নেব। তারপর দেশের শহরবন্দর, গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি বাড়িতে একটি করে নোবেল পুরস্কার ঢুকিয়ে দেশ ও জাতিকে ধন্য করবো।
প্লিজ চুপ করে থাকবেন না, কোন কোন দেশে গিয়ে ‘মাল খেলে’ নোবেল পাওয়া যায় তা আমাদের বলুন। আমরা সেইসব দেশে গিয়ে ‘মাল খাওয়া কাহাকে বলে এবং উহা কত প্রকার’ তা বিশ্বকে দেখিয়ে দেব। অবশ্য আরও একটা উপকার হবে, আমাদের আদম ব্যাপারীরাও উড়োজাহাজ, জাহাজ, ট্রলার, কনটেইনারের খোল ভরে ভরে বঙ্গসন্তানদের ওইসব দেশে পাচার করে টু-পাইস কামাতে পারবে। দেশের অর্থনীতিতেও তা কাজ দেবে।
আবার শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশিরাও আপনার কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য বেহুঁশ হয়ে ছুটে আসবে। তাতে আমাদের আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। প্রসার ঘটবে পর্যটন শিল্পেরও। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের সুনাম। আর ‘অমর’ হবেন আপনি।
দুই কান কাটা কাণ্ড : দিলীপের দড়াবাজি
বড় বড় মন্ত্রী-নেতাদের কারবার দেখে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া চুপ থাকেন কী করে? কুঁজোরও তো ইচ্ছে করে চিত্ হয়ে শুতে। ডান কান কাটা হাঁটে পথের ডান দিক ঘেঁষে। বাম কান কাটা হাঁটে পথের বাম ঘেঁষে। আর যার দুই কানই কাটা সে হাঁটে নাকি পথের মাঝ দিয়ে, বুক টান করে। অতএব মহাজোট সরকারের সঙ্গী বিশিষ্ট রাজনৈতিক এতিম, ‘তিন নম্বর বাচ্চা’ দিলীপ বড়ুয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেক নজরে পড়ার মওকা মিস করেন কী করে? ড. ইউনূসের গুষ্ঠি নিকাশের কাজে তিনি নাম লেখালেন।
এর আগে তিনি বলেছেন, উন্নয়নের ঠেলায় নাকি দেশে ফকির উঠে গেছে। সবাই সচ্ছল হয়ে গেছে। এই রাজনৈতিক সর্বহারা সারাক্ষণ থাকে পুলিশ আর অফিসারবেষ্টিত। তো তার আশপাশে ফকির আসবে কোত্থেকে। কিন্তু এই মন্ত্রী মহোদয়কে তা বোঝাবে কে? তিনি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় বুঝে নিলেন দেশে এখন আর ফকির নেই।
কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থানের সঙ্গে গাদ্দারি করে দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হয়েছেন। মান্নান ভূঁইয়া আর প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীরের দয়ায় যার নাকি জীবিকা নির্বাহ হতো। তিনি রাতারাতি মন্ত্রী বনে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেই পারেন। আবার বেগম জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে চীনও ঘুরে এসেছিলেন।
কিন্তু শিল্প দফতরের মন্ত্রী হওয়ার পরও তাকে নিয়ে কোথাও তেমন হৈচৈ নেই দেখে বোধ করি তার মন খারাপ থাকতো সবসময়। গ্রামেগঞ্জে একটা কথা আছে, পতিতার যখন বয়স বেড়ে যায়, সে হয়ে যায় খালা। কেউ আর তার দিকে তাকায় না। সঙ্গত কারণেই তার মন খারাপ থাকে। কেউ যাতে তার দিকে তাকায়, কেউ তাকে একটা গাল দেয়, সেই আশায় সে কি করে, পথের মাঝখানে মলত্যাগ করে। কোনো ব্যক্তি যদি অন্যমনস্কতাবশত সেই মলের ওপর পা দেয়, তো সে রেগেমেগে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করে। এই দৃশ্য আড়াল থেকে দেখে ‘খালা’ নাকি প্রাণ খুলে হাসে। বলে, যাক এখনও লোকেরা তাহলে আমাকে মনে রেখেছে।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া যিনি তিন-তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ১২০০-এর মতো। যার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে প্রতিবার, সেই ‘মহা জনপ্রিয়’ দিলীপ বড়ুয়া ড. ইউনূসকে ছুড়ে দিলেন কঠিন চ্যালেঞ্জ(!), ‘তত্ত্বাবধায়ক যদি এতই ভালো লাগে তাহলে রাজনীতিতে আসুন। রাজনীতিতে এসে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করে তারপর কথা বলুন।’—বুঝুন ঠেলা!
বেরসিক ব্যারিস্টার রফিক-উল হক
আমাদের কর্তাদের এইসব মন্তব্য, ভাষণ শুনে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মতোই বিরক্ত হন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার রফিক উল হক। তিনি গত ১২ মে এক আলোচনা সভায় বলেই ফেললেন, ‘একটি বড় দলের নেতা ও মন্ত্রী যদি মনে করেন শান্তিতে নোবেল পেতে হলে যুদ্ধ থামাতে হবে, তাহলে বোঝেন আমরা কত বড় বেকুবের দেশে আছি।’
দিলীপ বড়ুয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘তিনি ড. ইউনূসের নখের সমান হওয়ার যোগ্যও নন। একজন মন্ত্রী যদি বেকুবের মতো কথা বলেন তাহলে তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হয় না।’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের ওপর বলেন, ‘একজন মানি লোককে এভাবে অপমান করার চেয়ে আর জঘন্য কিছু হতে পারে না।’
ব্যারিস্টার রফিক উল হকের এই মন্তব্য প্রচারের পর অন্যরা খামোশ হলেও দিলীপ বড়ুয়াকে থামায় কে? তিনি তো সর্বহারা! তার তো মন্ত্রিত্বটুকু ছাড়া আর হারাবার কিছু নেই। সেজন্য আবার উচ্চকণ্ঠ হলেন। বললেন, ‘ইউনূসের মতো রক্তচোষা নই আমি।’
যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা যারা বলে তাদের চিহ্নিত করার জন্য বাংলা অভিধানে শব্দ আছে। সে সব শব্দ দিলীপ বড়ুয়ার ব্যাপারে ব্যবহার করলেই কি আর না করলেই কি? তার তো কিছু আসে যায় না।
সেজন্যই এই বেপরোয়া মন্ত্রী মহোদয় আবার বেপরোয়ার মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। তবে এবারের টার্গেট ড. ইউনূস নন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যারা টকশোতে অংশ নেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘টকশোধারীরা জেগে ঘুমান।’ তিনি তাদের ‘অন্ধ’ আখ্যায়িত করে বলেন, সেজন্যই তারা সরকারের উন্নয়ন দেখতে পান না।...তারা অদৃশ্য শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় বসতে চায়। তবে দেশের জনগণ তা হতে দেবে না।
উপসংহার
পর পর পাঁচবার ছেলে ফেল করেছে এসএসসি পরীক্ষায়। ষষ্ঠবার পরীক্ষার পর ছেলে যাচ্ছে রেজাল্ট আনতে। বাপ জব্বার মিয়া ডেকে বললো, শোন, এবার যদি ফেল করিস তাহলে ফিরে এসে আমাকে আর আব্বা বলে ডাকবি না। মনে থাকবে?
ছেলে মাথা নেড়ে বললো, জ্বি মনে থাকবে।
দুপুরে যথারীতি বিফল পুত্র বাড়ি ফিরে বাপকে খবরটা দেয়ার জন্য ডাকতে শুরু করলো, জব্বার মিয়া, ও জব্বার মিয়া—
রেগেমেগে ঘর থেকে বাইরে এসে জব্বার মিয়া ছেলেকে বললো, কিরে হারামজাদা, বাপকে নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিস...
ছেলে বললো, কী করবো, আপনিই তো বলে দিয়েছেন।
প্রিয় পাঠক, আমাদের ইউনূসবধ কাব্য দ্বিতীয় পর্বের এখানেই সমাপ্তি। আশা করি আমরা সবাই আগামী দিনগুলোকে চোখ মেলে দেখার জন্য আয়ু পাব।
a_hyesikder@yahoo.com