শনিবার, ২ জুন, ২০১২

ভারতীয় আগ্রাসনের অন্তরলোক : হারিয়ে যাওয়া হায়দারাবাদ



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
উপসংহার : পরাজয় এবং আত্মসমর্পণ
ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাক্ষীদের একজন স্যার মীর লায়েক আলী। যিনি ছিলেন নিজামের পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দেশের প্রধানমন্ত্রী। হায়দারাবাদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং অসহায় সাক্ষী।
সাক্ষী হিসেবে কাশেম রিজভীও ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন। কারণ তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই হায়দারাবাদের জনগণের নেতা। কিন্তু তিনি তার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে যাওয়ার সুযোগ পাননি। কারণ ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখলের পর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন কাশেম রিজভী। মাতৃভূমি হায়দারাবাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার জন্য যিনি নিজের সর্বস্ব উজাড় করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন, সেই কাশেম রিজভীর বিচার হয় দেশদ্রোহিতার অপরাধে। জীবনের বাকি দিন তাকে কাটাতে হয় ভারতীয়দের কারাপ্রকোষ্ঠে। তার কারাবরণ ও মৃত্যুর ভেতর দিয়েই চিরতরে নিভে যায় হায়দারাবাদের প্রাণের প্রদীপ।
উপসংহারে অন্য কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে সেজন্য লায়েক আলীর বর্ণনাকেই হুবহু তুলে ধরছি :
মাঝরাতের দিকে পশ্চিমে দায়িত্ব পালনরত ব্রিগেডিয়ারকে সেনাবাহিনী প্রধানের রুমে প্রবেশ করতে দেখা গেল। তিনি জানালেন, ভারতীয় বাহিনী রাতেই কিছু সময় আগে জহিরাবাদ পার হয়ে হায়দারাবাদের দিকে এগিয়ে আসছে। টুয়েন্টি-ফাইভ পাউন্ডের কামানের সীমায় প্রবেশ করতেই আমাদের বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে এবং চারটি ভারতীয় সেরমান ট্যাঙ্ক ওই হামলায় বিস্ফোরিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনী আবার জহিরাবাদের দিকে পশ্চাদপসরণ করেছে। তিনি মনে করেন, সকালের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী আবার সেখানে উপস্থিত হবে। সে কারণে তিনি ঘটনাবলি তুলে ধরার জন্য নিজেই চলে এসেছেন। তিনি বললেন, তিনি জানতে চান এখন তিনি কী করবেন। তাকে দেখে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল। তিনি চলে যাওয়ার পরপরই সেনাপ্রধান তার সম্পর্কে নিজের মতামত দিলেন। বললেন, তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব ভীত ও বিচলিত। এ অবস্থায় তিনি তার দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত। সেনাপ্রধান হেড কোয়ার্টার থেকে অন্য একজন ব্রিগেডিয়ারকে তার পরিবর্তে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য পাঠাতে মত দিলেন। নতুন ব্রিগেডিয়ারকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো। তিনি রওনা হওয়ার আগে আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, যে করেই হোক ভারতীয় বাহিনীকে এগোতে দেয়া যাবে না। আমি তাকে বললাম, হায়দারাবাদের ভাগ্য এখন তার হাতে। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, তিনি তার সব সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করবেন।
পশ্চিম আবারও যুদ্ধের ময়দানের অতিগুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে পরিণত হলো। পূর্বে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসরের নতুন কোনো খবর পাওয়া গেল না। পশ্চিমে নতুন একজনকে দায়িত্ব দিয়ে আমার স্বস্তি হচ্ছিল না। তাই আমি সেনাপ্রধানকে বললাম যেন তিনি নিজে সেখানে চলে যান। সবকিছু ঠিকঠাকমত চলছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখেন। তিনি চলে গেলেন। তার স্থানে একজন সিনিয়র স্টাফ দায়িত্ব তুলে নিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন এই কর্মকর্তা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং দ্রুত কর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। তিনি পূর্ব এবং পশ্চিমে মাইন পেতে রাখার দিকে জোর দিলেন। সামরিক ও অসামরিক বাহিনীর লোকদের দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন মাইন পুঁতে রাখার জন্য।
তখন ভোর ৪টা বাজে। ১৭ সেপ্টেম্বর। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টাফ আমাকে অনুরোধ করলেন বাড়ি ফিরে কিছু বিশ্রাম গ্রহণের জন্য। আমি দুই রাতের মধ্যে বিশ্রামের তেমন কোনো সুযোগ পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমি বিশ্রামের লক্ষ্যে আর্মি হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রওনা দিলাম। বাড়ি ফেরার পথে শাহ্ মনজিলে একবার দেখা দিলাম। চলে গেলাম সেখানে, যেখানে গোপন তথ্য ডিকোড করা হচ্ছিল। জানতে পারলাম, মুসতাক আহমেদ নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ক নতুন কোনো তথ্য পাঠাননি। বাড়ি পৌঁছে আমি বিশ্রাম নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখনি আমাকে জানানো হলো যে রেলওয়ের চিফ ফোনে হোল্ডে আছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি আমাকে জানালেন, বিবিনগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার তাকে জানিয়েছেন সেখানে গোলাগুলি হচ্ছে এবং ভারতীয় বাহিনী রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে বিবিনগর-হায়দ্রাবাদ রোড দিয়ে। ‘কি’? এটা কীভাবে হতে পারে? বিবিনগর রেলওয়ের কাছে গোলাগুলি হচ্ছে! ভারতীয় বাহিনী কী করে বিবিনগর পৌঁছল? কীভাবে হয়েছে তার উত্তর তিনি দিতে পারছিলেন না। কিন্তু তিনি বললেন, বিবিনগর দিয়েই ভারতীয় বাহিনী আসছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বিবিনগর থেকে রাজধানীর দূরত্ব মাত্র তিরিশ মাইলের মতো। সেই পথে প্রায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে! এটাই ছিল তখন পর্যন্ত আমার শোনা সবচেয়ে ভীতিকর তথ্য। তার মানে শুধু এই হতে পারে যে, হয় ভারতীয় বাহিনী নাকরাকালে অবস্থিত সব প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিয়েছে, অথবা তাদের কোনোভাবে পাশ কাটিয় এগিয়ে আসছে। পূর্বেও তারা দিলামকে পাশ কাটিয়ে হঠাত্ বিদরে উপস্থিত হয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফোন করলাম। আমাকে জানানো হলো, সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পূর্বে কোনো নতুন কিছু ঘটেনি। আমাদের সেনাবাহিনী ঠিকমতই আছে এখন পর্যন্ত, যদিও তাদের ওপর ভারতীয় বিমানবাহিনী খানিক সময় পরপর বোমা নিক্ষেপ করছে। আমি যা জানতে পেরেছি তা তাদের জানালাম এবং উত্তরে জানলাম, তারাও একটু আগেই একই উত্স থেকে সেই খবর পেয়েছে। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। তাদের কি থামানোর কোনোই উপায় নেই? হিসাব করে দেখা গেল, ভারতীয় বাহিনীর রাজধানী পৌঁছতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। তাদের আক্রমণ ঠেকানোর সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার সেখানে সৈন্য পাঠানোর কোনো ব্যবস্থাও নেই।
আমার কাছে তখন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। বিবিনগর থেকে সোজা অসুরক্ষিত পথে তারা রাজধানী পৌঁছে যাবে এবং এখন তাদের থামানোর জন্য করারও কিছু নেই। আমি হাতেমুখে পানি নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন থেকে কিছু আয়াত পাঠ করে পোশাক পরিধান করে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখন খবর পেলাম, সেনাবাহিনী প্রধান এসে পৌঁছে গেছেন। আর্মি কমান্ডারের জন্য কফি পাঠানোর নির্দেশ দিলাম। জানতে পারলাম, তিনি পশ্চিমে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে সোজা আমার বাসভবনে চলে এসেছেন। তাকে দেখে খুব ক্লান্ত ও ভীত মনে হচ্ছিল। তিনি জানালেন, আমার কথামত তিনি পরিদর্শন করে দেখেছেন। জানতে পেরেছেন, সেখানকার সৈন্যরা ক্লান্ত এবং তাদের মধ্যে তেমন কোনো শৃঙ্খলা নেই। সবকিছু বিবেচনা করে তিনি বললেন, ওই স্থানে কোনো হামলা হলে তারা সামাল দিতে পারবে না। তিনি আরও জানালেন, দিনের শেষে ভারতীয় বাহিনী এখানে পৌঁছে যাবে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে। সুতরাং যেটাই হোক, রাজনৈতিক কোনো সমঝোতায় আসতে হবে।
আমি স্থির চিত্তে তার কথা শুনলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পূর্ব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনো সংবাদ তার কাছে আছে কিনা এবং তিনি ‘না’ জবাব দিলেন। তাকে জানালাম রেলওয়ে চিফের কথা। তিনি শুনে আশ্চর্য হলেন এবং সমাধানে এলেন যে, ভারতীয় বাহিনী নিশ্চয়ই কোনোভাবে নাকরাকালে অবস্থিত বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি জানালেন, যদি তাই হয় তবে দুপুরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী রাজধানীতে এসে উপস্থিত হবে। তারপর কী হবে তা চিন্তা করাও ভয়ের।
আমি শাহ্ মনজিলে আমার ব্যক্তিগত অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জানতে পারলাম মুসতাক আহমেদ গোপন তথ্য পাঠিয়েছেন। তথ্য অবশ্যই প্যারিসে কী চলছে তা নিয়েই হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত বৈঠক শেষ পর্যন্ত ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে বসে। বৈঠকটি ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্যার আলেকজান্ডার কাডোগানের সভাপতিত্বে আয়োজিত হয়। বৈঠকে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, হায়দারাবাদের বিষয়টি বৈঠকে আলোচিত হবে কিনা। এটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। কারণ কিছু টেকনিক্যাল কারণে বিষয়টি বাতিলও হতে পারতো। চীনের প্রতিনিধি জিয়াং, যিনি কিনা পরিষদের একজন স্থায়ী সদস্য, তিনি প্রস্তাব রাখলেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনার তারিখ পিছিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর রাখার জন্য। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে কোনো মতামত তার সরকার এখনও তাকে দেয়নি। স্যার আলেকজান্ডার কাডোগান তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। বললেন, এটি একটি জরুরি বিষয়। সেহেতু এ বিষয় নিয়ে আমরা এগোব কি-না তা নিয়ে অন্ততপক্ষে সময় অপচয় করা উচিত নয়। ফ্রান্সের প্রতিনিধি পারোদি সভাপতির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করলেন। বেলজিয়াম দাবি করল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একদিন পেছানোর জন্য। জনাব মালিক (ইউএসএসআর) সভাপতির কাছ থেকে ১৯৪৭-এর ভারত স্বাধীনতা আইনের আলোকে হায়দারাবাদ বিষয়ক তথ্য এবং সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার অনুরোধ করলেন। যেহেতু তিনি যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি, তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে যত সম্ভব তিনি তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন, যখন উপযুক্ত সময় হবে। জেসোপ (ইউএসএ) বললেন, তিনি বিষয়টি পরিষদে আলোচনায় আনার পক্ষে। জনাব আরস (আর্জেন্টিনা) তার সঙ্গে শক্তভাবে একমত হলেন। বললেন, যখন একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেখানে নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে তখন জাতিসংঘ তাদের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে চলতে পারে না। কিন্তু আলাপ-আলোচনার পর চীনের প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণ করা হলো এবং যেহেতু চীন বাদে কেউ তাতে সমর্থন করছিল না, অতএব বাতিল হয়ে গেল। এবার হায়দারাবাদের বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হবে কি-না সে বিষয়ে ভোট হলো। আলোচনার পক্ষে ৮টি এবং বাতিলের পক্ষে ৩টি ভোট পড়ল। এরপর হায়দারাবাদের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচিত বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা পেল। সভাপতি আমন্ত্রণ জানালেন হায়দারাবাদের প্রতিনিধি মইন নেওয়াজ জঙ্গকে তার কেস তুলে ধরার জন্য। মইন নেওয়াজ জঙ্গ জোরদারভাবে তার বক্তব্য পেশ করলেন। তার বক্তব্যে তিনি বললেন যাতে নিরাপত্তা পরিষদ সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং রক্তক্ষয় থামিয়ে তার দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। কাজটি এমনভাবে সম্পাদন করে যেন তা হয় স্থায়ী। এবার এলো ভারতের পক্ষে বলার জন্য রামসোয়ামি সুহলির পালা। আক্রমণকারী পক্ষ হিসেবে তার আসলে বলার তেমন কিছুই ছিল না। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে হায়দারাবাদের কেস উপস্থাপনের বিষয়টি নিয়েই টানাটানি করলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি প্রমাণ উপস্থাপন করবেন যে হায়দারাবাদ কখনোই আসলে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না।
দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পর সভাপতি বৈঠক গুটিয়ে নিলেন। সব সদস্যকে বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য আদেশ করে দ্বিতীয় বৈঠকে বসার দিন ঠিক করলেন ২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। তাদের মতামত উপস্থাপনের জন্য বললেন সেই দিন। এই একটি সিদ্ধান্ত হায়দারাবাদকে শেষ করে দিল।
নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যদিও সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল, বিষয়টি সমাধানের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বরে পিছিয়ে দেয়া একটি তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করল। হায়দারাবাদের কর্তৃপক্ষ জানতো যে, ২০ সেপ্টেম্বর বেশি দেরি হয়ে যায়। সেই লক্ষ্যে তারা সম্পূর্ণভাবে চেষ্টা করল, প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বৈঠকটি এগিয়ে আনার অনুরোধ করলো। স্যার আলেকজান্ডার কাডোগান বললেন, চাইলেও এটা শনিবার ১৮ সেপ্টেম্বরে আনা সম্ভব হবে না। অস্ত্র সংবরণের প্রস্তাব নিয়ে সব প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করা হলো এবং চীন বাদে বাকি সব সদস্য তার পক্ষে মত দিল। যদিও রাশিয়ার এ বিষয়ে কোনো কিছু বলার ছিল না। পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে মোড় নেবে, এখন শুধু যদি হায়দারাবাদ ভারতকে সেই সময় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত ভারতীয় আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা হায়দারাবাদ সেনাবাহিনীর ছিল না।
সবকিছু বিবেচনায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তাত্পর্য এই মুহূর্তে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে অক্ষম। অন্যদিকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, রাজধানীর ত্রিশ মাইলের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশ করে ফেলেছে। আক্রমণের নির্দেশে তারা যদি রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসে, তবে সাধারণ জনগণের রক্তক্ষয়ের বন্যায় দেশের মাটি প্লাবিত হবে। ভারতীয় বাহিনীর গণহত্যার প্রবণতা আগেই বোঝা গেছে যখন তারা ওসমানাবাদ, কালিয়ানি, বিদর এবং আরও অনেক শহরের নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে হত্যা করেছিল। তাদের মূল ক্ষোভ ছিল ওইসব এলাকার মুসলিম জনবসতির প্রতি। এরই মধ্যে শহরগুলোতে যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় তবে হতাহতের মাত্রা কোথায় গিয়ে উঠবে তা চিন্তা করাও কষ্টকর। আমি আর সময় অপচয় করতে পারবো না। হয়তোবা নিজাম পারবেন ম্যাসাকার থামাতে। আমি ঠিক করে ফেললাম, আমি পদত্যাগ করবো এবং আমার মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও পদত্যাগ করার জন্য মতামত দিলাম।
আর্মি কমান্ডারের সঙ্গে কাজ শেষে আমি শাহ মনজিলে চলে গেলাম। সেখানে মুসতাক আহমেদের আরও কিছু গোপন তথ্য ডিকোড করা হচ্ছিল। তার মধ্যে একটি মেসেজে তিনি পাকিস্তানি নেতাদের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন যে তারা চায় আমি যেন দ্রুত হায়দারাবাদ ত্যাগ করি, যাতে ভারতীয় বাহিনী আমাকে পাকড়াও করতে সক্ষম না হয়। সেখানে প্যারিসের নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ক আরও কিছু তথ্য ছিল। আমি সেদিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে মন্ত্রিসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডাকলাম। কাসেম রিজভী আমার পরিস্থিতি জানার জন্য ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আমি তাকে জানালাম, পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি তাকে স্থির চিত্তে সবকিছু মোকাবিলার উপদেশ দিলাম এবং সাম্প্রদায়িক কোনো দাঙ্গা বা এরূপ কিছু এড়িয়ে চলার জন্য বললাম। তিনি আমাকে জানালেন, যুদ্ধ শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হওয়ার কোনো ধরনের আলামত পাওয়া যায়নি। এমনটি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এই বিপদের ভাগিদার হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই। আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করলাম। তাকে জানালাম এখনই সময় ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক একতাকে বড় করে দেখার।
সকাল ৮টার দিকে নিজামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হলো। তারও কিছুক্ষণ আগে তিনি আর্মি কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আমি তাকে প্যারিসে কী হচ্ছে তা খুলে বললাম। নিরাপত্তা পরিষদ এখন কীইবা করবে, যেহেতু তারা গোলাগুলি বন্ধ করার বিষয়ে একটি প্রস্তাবও পাস করাতে পারেনি। আলোচনা করে কী বা লাভ হবে। বললেন নিজাম, এত লোক মারা গেল, এত রক্তক্ষয় হলো, এখন কাদের পক্ষে তারা রায় দিতে চাচ্ছে? আর কিছু সময়ের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী তাদের অস্ত্রহাতে হাজির হবে, আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হবে? আমি কি বুঝছি না যে যুদ্ধরত অবস্থায় ভারতীয় বাহিনী যদি রাজধানীতে প্রবেশ করে, তবে কী পরিমাণ হতাহতের খবর আসবে, কী পরিমাণ রক্তক্ষয় ঘটবে! সেসব হতভাগ্যের কথা কি আমি জানি না, পূর্বে যাদের শহরে ভারতীয় বাহিনী হানা দিয়েছিল? আমি উত্তরে নিজামকে বললাম, হ্যাঁ, আমি জানি। যতটুকু দরকার আমি ততটুকু জানি এবং আমি তার চেয়েও বেশিই জানি। কিন্তু এত মৃত্যু সত্ত্বেও স্বাধীনতাই আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আমি নিজামকে জানালাম, তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলছেন আমি তা বুঝি এবং আমি তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। আমি জানালাম যে সকালেই আমি আমার পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং মন্ত্রিসভার সবাইকেও একই উপদেশ দিয়েছি। এখন পর্যন্ত যা বুঝছি, তারা সবাই আমার কথা মান্য করবে।
মন্ত্রিসভার সব মন্ত্রী এবং সিনিয়র সেক্রেটারিরা সবাই শাহ মনজিলে একত্রিত হয়েছিলেন। অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি পৌঁছেই তাদের সঙ্গে একত্রে সব কাজ শুরু করে দিলাম। সব ঘটনা তাদের খুলে বললাম। বর্তমান পরিস্থিতির অবস্থা তুলে ধরলাম। নিজামের মতামত তাদের জানালাম এবং এও জানালাম যে, নিজাম চান হয় সব দায়িত্ব তার নিজের হাতে তুলে নেবেন অথবা সব দায়িত্ব পরিহার করবেন এবং সেই মর্মে ঘোষণা দেবেন। আমি সবাইকে বললাম, তারা পরিস্থিতি যেন খুব ভালো করে বিবেচনা করে দেখে। এরপর তাদের মতামত স্পষ্টভাবে নির্ভয়ে প্রত্যেকে যেন আমাকে জানায়। কিছু সময়ের জন্য রুমটি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। উপ-প্রধানমন্ত্রী পিঙ্গেল রাধা রেড্ডী প্রথম নিস্তব্ধতাকে ভাঙলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের খাতিরে নিজের জান দিতেও প্রস্তুত। তিনি বললেন, নিজাম যদি মনে করেন যে কোনোভাবে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন, তবে তিনি বাধ্য সেই উপদেশ মেনে নিতে। এরপর তিনি তার পরিবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন। তিনি আরও বললেন, আমার দায়িত্বাধীন অবস্থায় সব সরকারি কর্মকর্তা এবং নাগরিক তাদের সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা দিয়ে দেশরক্ষার স্বার্থে কাজ করেছে এবং নিজেদের কখনোই দুর্বল মনে করেনি। তিনি আরও বললেন, যদিও একা যুদ্ধ করে বিশাল ভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের পরাজয় হয়েছে, আমরা প্রত্যেকে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশপ্রেমের জন্য যা করেছি, সবই ছিল সঠিক। এখানে অনুতাপের কিছুই নেই। তিনি বললেন, হয়তোবা এটাই তার শেষ বক্তব্য। হয়তো কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু সেই মৃত্যু কোনোভাবেই সম্মানহীন মৃত্যু নয় এবং তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, যদি আমি পদত্যাগ করি, তিনিও ধারাবাহিকভাবে পদত্যাগ করবেন।
তার বক্তব্য ছোট হলেও খুব তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও সংক্ষেপে একই রকম বক্তব্য পেশ করলেন। নিজামের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে একটি লিখিত দলিল তৈরি করা হলো, যেখানে বলা হলো যে মন্ত্রিসভার সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে দেশ রক্ষার্থে। কিন্তু ভারতীয় পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। তাই আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়া হলো এবং এই মর্মে প্রত্যেকে পদত্যাগপত্র নিজামের কাছে জমা দিচ্ছি। আমার তত্ত্বাবধানে পত্রটি নিজামের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়েই দেখলাম, কিছু স্টাফ অফিসার আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা আমাকে জানালেন যে ভারতীয় বাহিনীর গন্তব্য বের করার উদ্দেশ্যে যারা যাত্রা করেছিল তারা বিবিনগর এবং বিবিনগর পেরিয়ে আরও দূর পর্যন্ত খুঁজেও ভারতীয় বাহিনীর কোনো অস্তিত্ব পায়নি। দেখা যাচ্ছে, রেলওয়ে থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা ছিল ভুল। তারা এও জানাল যে, শুধু বিমান থেকে অনবরত বোমা নিক্ষেপণ ছাড়া পূর্ব-পশ্চিম যুদ্ধক্ষেত্রেও ভারতীয় বাহিনীর কোনো অগ্রসর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু পড়তে লাগল। যখন আমি তাদের জানালাম যে সরকার পদত্যাগ করেছে এবং নিজাম কিছু সময়ের মধ্যেই শান্তির বাণী ঘোষণা করবেন। ‘কিন্তু কেন স্যার’—তারা বলে উঠলো—‘আমরা এখন পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম। তাদের আক্রমণ আরও কিছু সময় আমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারবো।’ ‘সাব্বাস’, আমি তাদের বললাম। হয়তোবা আমরা শিগগির মারা যাব, কিন্তু আমাদের বিজয়ী চেতনা চিরকাল ধরে বেঁচে থাকবে।
নিজামের কাছ থেকে একটি জরুরি ফরমায়েশ এলো এবং আমাকে দ্রুত দেখা করতে বলা হলো। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন দেখলাম নিজাম পুলিশ প্রধান এবং আর্মি কমান্ডারকে নিয়ে আলোচনা করছেন একটি নতুন সরকার গড়ার বিষয়ে। তিনি ততক্ষণে মুনসির কাছে খবরটি পাঠিয়ে দিয়েছেন যে, আমার সরকার পদত্যাগ করেছে এবং নতুন সরকার গড়ার জন্য তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিবর্গের পরামর্শ চান। আমি এই বিষয়ক আলোচনাতে অংশগ্রহণ করিনি। আমি বৈঠক শেষে নিজামের সঙ্গে দেখা করলাম। মত দিলাম, এটা আশা করা উচিত নয় যে এত সহজভাবে সব হয়ে যাবে। আরও উপদেশ দিলাম, অফিসে রক্ষিত গোপনীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস করে ফেলতে। তিনি আমার মত নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলেন এবং তারপর তার পার্সোনাল সেক্রেটারিকে আদেশ দিলেন অফিস থেকে সব গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং ফাইল বের করে ধ্বংস করে ফেলতে।
আমি শাহ মনজিলে ফিরে গেলাম এবং সেখানে সব গোপনীয় দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং বিশেষ করে গোপন তথ্য ডিকোড করার যে কি-গুলো ছিল তা সবই ধ্বংস করে ফেলার আদেশ দিলাম। এরপর মুসতাক আহমেদের কাছে একটি মেসেজ পাঠালাম। এটিই ছিল তার কাছে পাঠানো শেষ মেসেজ। মেসেজে তাকে জানালাম, ভারতের সামরিক শক্তির কাছে আমরা পরাজিত এবং নিজামের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেছি। এটিই হয়তো আমার শেষ মেসেজ। হয়তোবা কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবো। তাকে এও বললাম, আমরা যদি নাও থাকি, তিনি যেন আমাদের পতাকা ওড়াতেই থাকেন। সর্বশক্তি দিয়ে যেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি তার যুদ্ধ চালিয়ে যান।
নিজামের কাছ থেকে ফেরার সময় আমি মুনসিকে কল দিয়েছিলাম। তিনি ভারতের সঙ্গে ফের টেলিফোন, বেতার এবং টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। আমি জেনে অবাক হয়েছিলাম, নিজামের মতোই তিনিও আবার সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে তার স্টাফদের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন। এমন একটি সরকার যার প্রধান উপদেষ্টা হবেন তিনি। আমি মুনসিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অনেক মিথ্যা প্রচার থাকলেও বাস্তবে কোথাও হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা হায়দারাবাদে ঘটেনি। আমি তার কাছে আশা রেখে অনুরোধ করেছিলাম, আগত আর্মি কমান্ডারদের নিয়ে ভালো কাজে লাগাতে। যেমনটি পূর্ববর্তী শহরগুলোতে করেছে, সেখানে যেমন গণহত্যা চালানো হয়েছে তা যেন এখানে না করে। আমার কথা তার মর্মকে স্পর্শ করেছিল বলে মনে হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন যেন দখলদার বাহিনী সাধারণ জনগণের ওপর কোনো হত্যাযজ্ঞ না চালায়।
নিজামের একটি টেলিফোন কলে রাখা অনুরোধের কারণে আমি তার সঙ্গে একত্রে শুক্রবারের নামাজ আদায়ের জন্য গণউদ্যানে অবস্থিত সুন্দর ছোট মসজিদটিতে হাজির হই। নামাজ শেষে নিজাম আমার কাছে কিছু সময় চেয়ে নিলেন। আমি রাজি হলাম। পরে আমি সেখান থেকে শাহ মনজিলে চলে আসি, সেখানে সব গোপন নথিপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে কিনা তা তদারকি করে দেখার জন্য।
সেদিন বিকালের দিকে আমি একবার হায়দারাবাদ রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলাম হায়দারাবাদের জনগণের উদ্দেশে একটি মেসেজ বেতারে ঘোষণার জন্য। খুবই সংক্ষেপে আমার বক্তব্যে আমি বলি—হায়দারাবাদের এখন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। স্বাধীনতা রক্ষায় সফল না হওয়ায় সরকার পদত্যাগ করেছে। আমি আরও বললাম, এই বিপদে প্রত্যেক নারী-পুরুষ এবং শিশু যেন সাহস না হারায়। ধৈর্যচ্যুত না হয়। আমি তাদের উপদেশ দিলাম এক নতুন শাসন ব্যবস্থার জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে। এমন এক শাসন ব্যবস্থার জন্য, যার সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারার কোনো মিল নেই। আমি তাদের বিশেষভাবে নজর দিতে বললাম যেন কোথাও একটিও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ না হয়। আমরা সব সময় মিলেমিশে যেভাবে চলেছি, তা ভুলে যেন নিজের জাতকে এমন অমঙ্গলজনক কাজে রক্তাক্ত না করি। আমি তাদের বললাম খোদার ওপর বিশ্বাস রাখতে এবং তাদেরকে তারই হাতে ছেড়ে দিলাম।
ফেরার পথে আমি লক্ষ্য করলাম, পথে দোকানে-বাজারে যেখানেই রেডিও আছে সবগুলোরই ভলিউম বাড়ানো। সেখানে মানুষ ভিড় জমিয়েছে। সবাই আমার বক্তব্য শুনেছে। তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল সমগ্র হায়দারাবাদ যেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই কেমন যেন একটি ছোট পাথরের মতো হয়ে গেছে। দৃশ্যটি দেখে নিজের অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি শাহ মনজিলের পথে রওনার সময় কাসেম রিজভীকে টেলিফোনে একটি দায়িত্ব দিলাম। তাকে বললাম যেন রেডিওতে তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার জন্য, শান্তি বজায় রাখার জন্য। প্রথমে যদিও তাকে অনিচ্ছুক দেখাচ্ছিল, পরে তিনি এমন এক ভাষণ দেন রেডিওতে যা ছিল চিত্তাকর্ষক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাষণে তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, কেউ যেন শান্তি-শৃংখলা এবং আইন ভঙ্গ না করে এবং সাম্প্রদায়িক গোলযোগে না জড়ায়।
আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যেসব গোলাবারুদ এবং অস্ত্র ছিল তা ধ্বংস করে ফেলা ছিল আমার জন্য একটি চিন্তার বিষয়। আমি ক্ষমতা ছাড়ার আগে সাধারণভাবেই একটি আদেশ দিয়েছিলাম এ বিষয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, আমি ক্ষমতায় না থাকা সত্ত্বেও আমার আদেশ সব কর্মচারী ঠিকমতই পালন করলো।
তখন একটি ছোট ঘটনা আমার মর্মকে স্পর্শ করেছিল। আবদুর রহিম নামে আমার মন্ত্রিসভার এক সদস্য আমার কাছে ছুটে এসে করুণভাবে একটি আবদার রেখেছিলেন। বলেছিলেন যেন কোনোভাবে কাসেম রিজভীকে আমি পাকিস্তান বা অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করি। তিনি বলেছিলেন, আমি জানি কিছু সময়ের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী এখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের সবাইকে গুলি করে মারবে। কিন্তু তারা কাসেম রিজভীকে কেটে টুকরো টুকরো করে মারবে। তার দেহাবশেষ শকুনের ভক্ষণের জন্য দেবে। আমি তার পরার্থপরতা এবং আন্তরিকতা দেখে আন্দোলিত হয়েছিলাম। আমি আর্মি কমান্ডারকে ফোন করি এবং তাকে জিজ্ঞাসা করি, কাসেম রিজভীকে কোনোভাবে বিমানে করে পাঠিয়ে দেয়া যায় কিনা। কিন্তু দুঃখজনক যে তিনি বলেন, এটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ ভারতীয় বিমান সর্বত্র পাহারা দিচ্ছে এবং আমাদের বিমান উড়তে দেখলেই তাকে ভূপাতিত করবে।
এরপর আমি ঠিক করলাম নিজামের সঙ্গে সাক্ষাত্ করা কমিয়ে আনব। কিন্তু কাজ হলো না। দেখা গেল, নিজাম নিজেই বারবার আমাকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ডাকছেন। এমনি এক সাক্ষাত্কারে আমি উপস্থিত। উপস্থিত হয়ে লক্ষ্য করলাম, আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব অর্থাত্ তরবারি কে তুলে দেবে বিপক্ষের আর্মি কমান্ডারের হাতে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। আর্মি কমান্ডার মনে করছিলেন, এই কাজের জন্য তিনিই হলেন সঠিক ব্যক্তি। কিন্তু বৈঠকে উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অনেকেই মনে করছিলেন, এই দায়িত্ব বহন করা উচিত রাজকুমারের (বিদরের রাজকুমার); যিনি কিন্তু আনুষ্ঠানিক কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন। নিজাম এ ব্যাপারে এতটাই দুঃখিত ছিলেন যে তিনি এ বিষয়ে আমার মতামতটুকুও চাইলেন না।
সেদিন সন্ধ্যাতেই মুনসি একটি কূটনৈতিক এবং বুদ্ধিমান চাল চাললেন। তিনি নিজামকে বাধ্য করেন রেডিওতে নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্দেশ করে এই মর্মে বক্তব্য পেশ করতে যে, এটা তার আদেশ, যেন হায়দারাবাদের প্রতিনিধিবর্গ তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। এরপর মুনসি নিজেই একটি বক্তব্য রেডিওতে প্রদান করে। দুটি বক্তব্য মিলে এমন দাঁড়ায় যে, আগের সব সরকার ছিল বিপথে এবং বিশেষ করে এই শেষ সরকার তাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট। এখন সব ভুল সংশোধনের সময়। এই মর্মে হায়দারাবাদ এখন ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে আমি যখন সুযোগ পাই, নিজামকে জিজ্ঞাসা করি যে পরামর্শ মোতাবেক সব গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিল ধ্বংস করা হয়েছে কিনা। নিজাম আমাকে নিশ্চয়তা দেন, তা সবই হয়েছে। পরে ১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে আর্মি কমান্ডার এবং তার স্টাফরা জিপে করে মেজর জেনারেল জয়ন্ত নারায়ণ চৌধুরীকে বলারামের বাসভবনে নিয়ে আসেন। চৌধুরী ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বে। নিজাম সেখানে তার নিজের পক্ষের লোক পাঠালেন। যাদের মধ্যে ছিল জুলকাদের জঙ্গ, আবুল হাসান সাঈদ আলী, আলী ইয়াভোর জঙ্গ এবং আরও এক কি দু’জন। তারা সেখানে নিজামের পক্ষ থেকে তাকে শুভেচ্ছা জানায় এবং নিজাম মুনসির মতামত গ্রহণে নতুন যে সরকার গঠনের নকশা প্রস্তুত করেছেন তা পেশ করেন। যেন তা তার গ্রহণযোগ্যতা পায়। পরে বিকালে আবারও নিজামের ডাকে যখন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই, আমাদের সাক্ষাতের মাঝে নিজামের পক্ষ থেকে পাঠানো দূতরা ফিরে আসেন। তাদের চেহারা মলিন সবুজ বর্ণ ধারণ করেছিল। তারা জানান দিল যে, জেনারেল চৌধুরী তাদের সরকার গঠনের প্রস্তাব নাকচ করেছে এবং নিজামের এ বিষয়ক সব মতামত তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন বলে বলেছেন। তারা জানান দিলেন যে, তিনি বলেছেন তিনি মার্শাল ল কায়েম করবেন। সামরিক শাসনে দেশ চলবে এবং তিনি নেবেন শাসনভার। ‘কী! কী!’ নিজাম চিত্কার করে উঠলেন। এরপর তিনি আমার দিকে ফিরে জোর কণ্ঠে বললেন—‘কিন্তু লায়েক আলী, মুনসির সঙ্গে তো আমার এমন কথা হয়নি।’ ‘আমি বুঝতে পারছি’—জবাব দিলাম আমি। কিন্তু তিনি আমার কথার কোনো পাল্টা উত্তর দিলেন না। আমি বুঝতে পারলাম, এই বৈঠকে আমার উপস্থিতি কাম্য নয়। তাই আমি নিজামের অনুমতি চাইলাম সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। নিজাম আমাকে অনুমতি দিলেন। তবে বললেন যেন পরদিন সকালে আমি তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। কিন্তু এমনটি আর কখনও হয়ে ওঠেনি।
বাড়ি ফিরে আমি জানতে পারলাম, ভারতীয়রা ১৯ তারিখ দুপুরে পশ্চিম থেকে এবং বিকালে পূর্ব থেকে রাজধানীতে প্রবেশের পরিকল্পনা করেছে। পরে সন্ধ্যায় একজন বার্তাবাহক পুলিশ চিফের কাছ থেকে আমার জন্য একটি চিঠি নিয়ে আসে। এটি ছিল মূলত মিলিটারি গভর্নরের পক্ষ থেকে। তিনি আমাকে আদেশ করেছেন যেন আমি ঘর থেকে বের না হই। আমি এখন একজন গৃহবন্দি। আমি তত্ক্ষণাত্ ব্যবস্থা করে দেই যেন আমার স্ত্রী, বোন এবং সন্তানরা নিরাপদে সেখান থেকে দূরে কোনো বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেয়। অন্ততপক্ষে আমার জান নেয়ার দৃশ্য তাদের যেন প্রত্যক্ষ করতে না হয়। তাছাড়াও আমার পরিবারবর্গের কাউকে যেন তারা লাঞ্ছিত করতে না পারে, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আমার সঙ্গে আর কেউই রইল না। শুধু আমার বাল্যকালের আরবীয় বংশোদ্ভূত একজন শিক্ষক বাদে, যিনি কিনা ছোটবেলা থেকে আমার ওপর নজরদারি করে এসেছেন। পুলিশ চিফের কল এলো এবং তিনি আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তার দ্বারা এমন কাজ করানো হচ্ছে তার জন্য তিনি লজ্জিত। আমি তাকে বললাম, এখানে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমি ব্যাপারটি বুঝতে পারছি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাসেম রিজভীর কী হবে। তিনি আমাকে জানালেন, পরদিন সকালেই তাকে উঠিয়ে আনা হবে।
কিছুক্ষণ পর কাসেম রিজভীর তরফ থেকে একটি ফোন আসে। তাকে সব সময়ের মতোই প্রফুল্ল শোনাচ্ছিল। তিনি পরদিন সকালে আমার সঙ্গে নাস্তা করার অনুমতি চাইলেন। যেমনটা আগেও বহুবার তিনি আমার সঙ্গে করতেন। আমি তাকে কী উত্তর দেব বুঝে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ আমি তাকে জানালাম, আমার বাড়িতে তিনি সব সময়ই স্বাগত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি জানতেন না তার সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে।
আমাকে একা রেখে দূরে থাকা আমার পরিবারের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছিল। পরদিন সকালে হঠাত্ তারা বাসায় উপস্থিত হলো। তারাও আমার পরিণতি তাদের নিজেদের জন্য বরণ করে নিয়েছে। কী করে তারা এখানে আবার এসে পৌঁছাতে পেরেছে তা ছিল বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। আমার বাসার সব টেলিফোনের লাইন কেটে ফেলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি কী হচ্ছে তা সম্পর্কে মোটামুটি খবর পেতে থাকি। জানতে পারলাম, পূর্ব এবং পশ্চিম থেকে সেনাবাহিনীরা প্রবেশ করে বলরাম মিলিটারি স্টেশনের দিকে মার্চ করে আসছে। যেখানে কিনা ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগের আগে অবস্থান করতো।
সেদিন রাতে একজন লম্বা এবং সুঠামদেহী ভারতীয় সেনা অফিসার আমার বাসায় এলেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। তিনি ছিলেন কর্নেল পদমর্যাদাপ্রাপ্ত। তিনি আমাকে স্পষ্টভাবে কিন্তু ভদ্র ভাষায় বললেন, সকালে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি হেসে তাকে বললাম—‘ফায়ারিং স্কোয়াড কি আমাকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকবে?’ আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটলো। আমি দেখতে পেলাম তার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি আমার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং প্রশ্নের জবাব না দিয়েই সেখান থেকে তাকে যেতে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। হঠাত্ করে এমন খবর শুনে আমার স্ত্রী, বোন এবং সন্তানরা আতঙ্কে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার পরিবার ছিল সাহসী। কিছু সময় পর তারা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। সম্ভবত সেদিন রাতে তারা কেউই ঘুমায়নি। আমি আমার পরিবারের লোকদের সঙ্গে আলাপ, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এবং ঘুম—এসবের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে বেশকিছু সেনাবাহিনীর গাড়ি আমার বাসভবনকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু কেউই প্রবেশ করে না। আমরা দিনের আলো ফুটে সূর্য আরও আলোকিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ রাখছিল। কিছু সময় পর সেনা গাড়িবহর ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে চলে গেল। আমরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু কোনো ঘটনাই ঘটলো না। হয়তোবা নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের কারণে এনমটি হলো। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো। ঘণ্টা থেকে দিন। দিন পেরিয়ে মাস। মাস পেরিয়ে বছর। এ সময়ের মধ্যে আমাকে নিয়ে কিছুই করা হলো না। আমি তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনেও করতে পারছি না, যা কিনা সে সময় ঘটেছিল। তারপর একদিন সৌভাগ্যক্রমে সুযোগ এসে গেল। আমি হায়দারাবাদ ছেড়ে পালালাম। পালিয়ে বাঁচলাম। আমরা অনেকেই বাঁচলাম। কিন্তু চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল স্বাধীন হায়দারাবাদের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। বিলীন হয়ে গেল বৃহত ভারতের মধ্যে।
a_hyesikder@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন