আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক.
কথাশিল্পী আবু রুশদের একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ২২ জুন ১৯৯০-এ দৈনিক বাংলায় (দৈনিক বাংলা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যা করেছেন। সেজন্য বলতে হবে অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত সেই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আরেকটি জিনিস ঘটে, হয়তো একজন লেখক সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকটি উচ্ছ্বসিত ধরনের আলোচনা বা নিবন্ধ বের হয়ে গেল। অথচ সেই লেখক শক্তিশালী কেউ নয়। তাই—পাঠকরা এ ধরনের অতি উত্সাহী আলোচনা দেখে সেই লেখককে যখন যাচাই করতে যায়, দেখে বেশ ফাঁক রয়ে গেছে। তখন সামগ্রিকভাবে আমাদের লেখকদের সম্পর্কে নিরুত্সাহী হয়ে পড়ে তারা। হতাশ হয়ে যায়।’
এই অভিজ্ঞতাটা আমার ঝুলিতে আছে। অনেক অতি প্রগলভ, উচ্ছ্বাসের ফেনায় ভেসে যাওয়া গ্রন্থালোচনা পাঠ করে মূল বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়েছি। মনে হয়েছে গ্রন্থালোচক আমাকে প্রতারিত করেছেন।
দলবাজি, গ্রুপবাজি, অশিক্ষা ও অপুষ্টির শিকার আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ঘাড়ে চেপে বসেছে এক ধরনের প্যারাসাইট। এই পরান্নভোগীরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চায় চোখ। স্রেফ ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এদের বিচারবুদ্ধি হয় বিলুপ্ত। বড় হয়ে ওঠে উচ্চাভিলাষ। এজন্য কারণে-অকারণে নিজেদের এই নোংরা টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত লেখক যত জগামগাই হোক, কল্কি পেয়ে যান। যদুর চরকায় তেল দেয় জব্বার, জব্বারের চরকায় তেল দেয় মধু। মধু আবার যদুকে বড় করে তোলে। এই চক্রে এখন পচা পাগাড়ে আবদ্ধ শুয়োরের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য।
এই চক্র নিজেদের লেখক ও লেখকের বইকে নিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। আর তাদের হিসাবের বাইরের লেখক ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে থাকে নিঃশব্দ। এখন আবার এই প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে চটকদার বিজ্ঞাপন। নতুন আরেকটি ফ্যাশন এখন আমাদের সাহিত্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টাটাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বইয়ের মার্কিং করে এ বছরের সেরা ১০ বই, বছরের সেরা ৭ বই ইত্যাদি নামে। এসব ভাগ্যবান বই বা লেখক তাই বলে বাইরের কেউ নয়, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার খোঁয়াড়েই লালিত-পালিত বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন বাচাল লেখক।
কখনও কখনও বড় কিংবা আলোচিত হওয়ার জন্য লেখকদের মধ্যেও কাজ করে নানা ধান্ধাবাজি। এই ধান্ধাবাজির একদিকে থাকে চালাকি, শ্রমবিমুখতা ও তাস্কর্যবৃত্তি। অন্যদিকে থাকে ক্ষমতাসীনদের পা চেটে, তাদের স্তাবক বা নিশানবরদার সেজে ইহলৌকিক তরক্কি অর্জন।
এই জাতীয় লেখক দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছেন আমাদের দুই জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান। একই বই শত শত নামে বেরিয়েছে এ দুজনের জন্য।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক তোলপাড় করা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’র স্রষ্টা ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ‘কত ছবি কত গান’। সেই ইলিয়াস ভাই ’৭১-এর পরে মুজিব বন্দনার সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন ‘মুজিববাদ’ বই দিয়ে। ইলিয়াসের পাঠকরা এতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। আর বিরক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারা। কারণ তাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের বাড়া ভাত যেন কেউ কেড়ে দিতে চাচ্ছে। মুজিববাদের জন্যই ডুবলেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
ড. মাযহারুল ইসলামের বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পড়ে স্বয়ং শেখ মুজিব নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বইটির তথ্যগত ভ্রান্তি এবং বল্গাহারা বিশেষণ প্রয়োগের তাণ্ডব ধরিয়ে দিলে চুপসে যান গ্রন্থকার।
জিয়াউর রহমানকে নিয়েও একই কাণ্ড চলছে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের দ্বারা। এখানে আছে নানা সাইজ ও আয়তনের মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। বিভিন্ন লেখকের লেখা কালেকশন করে এক একজন এক একটা বই বের করেছেন। নিজের নাম ফাটানোর জন্য আছে নানা কায়দা। আবার এই একটি সংগ্রহ থেকেই লেখা নিয়ে আরও চল্লিশজন চল্লিশ নামে বের করেছেন বই। এর কোনো কোনোটির ওজন পাঁচ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নির্যাস নেই পাঁচ ফোঁটাও।
দুই.
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিরচিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনয়িন : গৌরবের দিনলিপি’। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন অ্যাডর্নেরই স্বত্বাধিকারী বন্ধুবর সৈয়দ জাকির হোসাইন। কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য এ ধরনের বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণ গড়পড়তা সাইজ নয়, রয়াল সাইজের এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৭৪। ওজন আনুমানিক ৩ কেজিরও বেশি। বৃদ্ধ এবং শিশুদের পক্ষে এ ধরনের বিশাল গ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, নাড়াচাড়া করাও দুঃসাধ্য।
যে কেউ এরকম জলহস্তির মতো বিরাট কলেবরের বই দেখে সত্যি সত্যি ভিরমি খেতে পারেন।
কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই যেহেতু ঘর পোড়া গরু, সেহেতু ভয় না পেয়ে উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করলাম। যাকে বলে আগাগোড়া স্কানিং করা, সে রকম পাঠ সমাপ্ত করতে মাসখানিক লাগার কথা। আমি বইটি ঘাঁটার (পড়ার জন্য নয়) জন্য সময় নিয়েছি মাত্র দুদিন। সে জন্য এ লেখাকে পাঠ-পরবর্তী নিবেদিত কোনো প্রবন্ধ হিসেবে না দেখে একটা দ্রুতরেখ মানচিত্র বলে ধরে নিলেই বাধিত হবো।
তিন.
ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘ইতিহাস এমনি একটি বিষয়, যা কখনও ঘটেনি এবং এমন লোকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, যে কখনও সেখানে ছিল না।’ প্রথমেই বলে নিই, এ বই সে রকম কোনো ইতিহাসবিদের রচনা নয়। এ বইয়ের লেখক মাহফুজউল্লাহ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক। কখনও তিনি নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা, কখনওবা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে আসা সচেতন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী, কখনওবা নেতা। সঙ্গত কারণেই ছাত্র ইউনিয়নের বিচারে তিনি ইতিহাস-মানুষ। ফলে অন্য দশটি তথাকথিত ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থকার ও গ্রন্থের ফারাক সুস্পষ্ট, দূরত্বও অনেকখানি। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য মানুষের মতো ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান’-এর মতো রুচিহীন কাজ এ গ্রন্থে কোথাও করেননি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনার স্তূপ তিনি খাড়া করেননি। অথচ এর সুযোগ ছিল। এই যে মাত্রাবোধ ও কাণ্ডজ্ঞান, সে জন্যই মাহফুজ উল্লাহ তার এই গ্রন্থের জন্য নন্দিত হবেন। পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখার জন্য এ বই যেমন পাবে পাঠকপ্রিয়তা, তেমনি অর্জন করবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা। এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ জোগাবে উপকরণ ও অনুপ্রেরণা। সে বিচারে এ বই জাতীয় ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি মাহফুজ উল্লাহর এই সময়োপযোগী প্রকাশনাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঠিক গ্রন্থ নয়, এ হলো একটা আর্কাইভস। একটি বিশাল আর্কাইভসের অক্ষরবন্দি রূপ। এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনুধাবনের নানা জিনিসপত্র। কেবল যেন পাঠের জন্য নয়, এ বই রচিত হয়েছে বিচরণের জন্য। উদ্যানের মধ্যে যেমন আমরা হেঁটে বেড়াই, এগাছ-ওগাছের কাছে যাই, এফুল-ওফুলের গন্ধ নেই, বর্ণ দেখে চমত্কৃত হই, কখনও হই বিচলিত—এ হলো সে রকম একটি আয়োজন।
আবার আমাদের ইতিহাসের অনেক হারিয়ে যাওয়া ভূভাগ, বিলুপ্ত অনেক অলিগলি, অনেক মানুষের অপরিসীম ত্যাগের কাহিনী পাঠক এর মধ্যে পাবেন। পাবেন একটি জাতির উত্থান এবং কিছু মানুষের পতনের বেদনাহত সূত্র। এজন্য এ বই আমাদের নিজেদের দেখার আয়নাও বটে। হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। এই পাঠে আমরা বিস্মিত হই, শিহরিত হই, ব্যথিত হই। কিন্তু আয়না থাকে নির্বিকার। এই নির্বিকারত্বই এ গ্রন্থকে মানোত্তীর্ণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি গ্রন্থ বিচারে বসি আমরা, তাহলে যে কেউ স্বীকার করবেন এই গ্রন্থ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশেরও ইতিহাস। এ গ্রন্থ শুধু ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি নয়, জাতীয় গৌরবেরও দিনলিপি।
চার.
বইয়ের শুরুতেই সবিনয় নিবেদনে লেখক বলেছেন, ‘আট বছরের পরিশ্রমের ফসল যে বইটি এখন হাতে নিয়েছেন তা প্রথাসিদ্ধ কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাস রচনার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের ভাণ্ডার।’ আসলেই এ গ্রন্থ একটা উপাত্তের ভাণ্ডার। ১২৭৪ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এ বই ধারণ করেছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৯ বছর।
ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই চারটি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সংগঠনটির জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাবান মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হন। এ ছাত্ররাই কর্মজীবনে দিয়েছেন প্রভূত সাফল্যের পরিচয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যে সময়সীমার কথা নিয়ে এ গ্রন্থ, সে সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ছাত্র ইউনিয়নই ছিল সবচেয়ে প্রাগ্রসর সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সদস্যদের দিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। করেছিল গভীরভাবে আত্মপ্রত্যয়ী। দিয়েছিল গৌরবময় জীবনের সন্ধান। যে গৌরবের সৌরভ আমাদের মতো অভাজনের গায়ে এখনও লেগে আছে।
মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ১৯টি পরিশিষ্টে সৃষ্টি হয়েছে এই বই। প্রতিটি অধ্যায় চিহ্নিত হয়েছে এক-একটি বছরের নামে। এই অধ্যায়গুলোর শুরুতেই আছে মূল বিষয়ের ওপর লেখকের কিঞ্চিত্ আলোকপাত। এরপর আছে ঘটনা প্রবাহ, যা গড়ে উঠেছে কেবল সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কাটিং নিয়ে। তারপর সংযুক্ত হয়েছে তথ্য নির্দেশ, যা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১৮টি অধ্যায়।
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর আলোকপাত, যা লেখকের নিজের লেখা, খুবই সংক্ষিপ্ত, একই সঙ্গে সংযমী ও পরিমিত। বাচালতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি মাহফুজ উল্লাহ।
পরিশিষ্টের ১৯টি অধ্যায় আসলে ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্টস, যা ইতিহাস গবেষকদের জন্য খুলে দেবে এক শস্যভারানত দিগন্ত।
আরও দিকের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আত্মবিশ্বাসহীন লেখককুলের অনেকেই বইয়ের ‘দাম’ বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট কেউকেটাদের দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে তার বাণিজ্যিক ব্যবহার। মাহফুজ উল্লাহ এই কদর্য কাজটি করেননি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই, এই ফাঁকে একটা ধন্যবাদ কি আপনাকে দেব?
আর একটা প্রশ্ন, বর্তমানকার অন্তঃসারশূন্য, দলবাজ ছাত্র সংগঠনগুলো এই বই থেকে কি কিছু শিক্ষা নেবে?
পাঁচ.
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন মাঝেমধ্যেই ভারি ভারি কিতাব প্রকাশ করে। সেগুলো কতটুকু খাদ্য আর অখাদ্য তা বলতে পারবো না। কিন্তু সেসব দেখে চোখ জুড়িয়েছে। বিশেষ করে আনোয়ার দিল অ্যান্ড আফিয়া দিল প্রণীত ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ সম্পাদিত ‘মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ : বাংলাভাষা স্মারক’-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ড. মাহবুব উল্লাহর গ্রন্থটি যখন বের হয় তার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে আমি অষ্টপ্রহর জড়িত। কিন্তু ভুলেও তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তিনি আমার মতো অনেক আমজনতার কাছে পুরো বিষয়টি চেপে রাখেন।
হয়তো তিনি আমাদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রকাশের পর ১০ কেজি ওজনের ঢাউস বইটি তিনি যখন আমার হাতে দেন, আমি আঁেক উঠি এবং হতবাক হই। আরও হতবাক হই, দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তার মোটামুটি জীবনপঞ্জি আছে বইটিতে। কিন্তু তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী—তার উল্লেখ নেই। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের হাতে এমনটা হয়েছে হয়তো তথ্য সংকটের কারণে। তো এই হতবাক দশা এখনও কাটেনি বলে মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের শত গালাগাল শুনেও বইটি নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা হয়ে ওঠেনি।
শেষ করার আগে মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ। কারণ তিনি জানেন ‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ সেজন্যই সেই নারী, তার গৃহের জিম্মাদার দিনারজাদী বেগমকে তিনি ভোলেননি। তার সবিনয় নিবেদন শেষ হয় তার নাতি-নাতনীদের জন্য আশাবাদে—‘আমার তিন নবীন প্রজন্ম আরমান রাকিন হক, দিয়ান জাকারিয়া ও জাহরান হাবীব যদি বড় হয়ে আমার যৌবনে লালিত বিশ্বাসকে ধারণ করে, তাহলে এই বই লেখা সার্থক হবে।’
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ যদি এই বই পাঠ করে উপকৃত হয়, উজ্জীবিত হয়, বাংলাদেশের দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে আসে—তাহলেই হলো।
a_hyesikder@yahoo.com
কথাশিল্পী আবু রুশদের একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ২২ জুন ১৯৯০-এ দৈনিক বাংলায় (দৈনিক বাংলা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যা করেছেন। সেজন্য বলতে হবে অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত সেই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আরেকটি জিনিস ঘটে, হয়তো একজন লেখক সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকটি উচ্ছ্বসিত ধরনের আলোচনা বা নিবন্ধ বের হয়ে গেল। অথচ সেই লেখক শক্তিশালী কেউ নয়। তাই—পাঠকরা এ ধরনের অতি উত্সাহী আলোচনা দেখে সেই লেখককে যখন যাচাই করতে যায়, দেখে বেশ ফাঁক রয়ে গেছে। তখন সামগ্রিকভাবে আমাদের লেখকদের সম্পর্কে নিরুত্সাহী হয়ে পড়ে তারা। হতাশ হয়ে যায়।’
এই অভিজ্ঞতাটা আমার ঝুলিতে আছে। অনেক অতি প্রগলভ, উচ্ছ্বাসের ফেনায় ভেসে যাওয়া গ্রন্থালোচনা পাঠ করে মূল বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়েছি। মনে হয়েছে গ্রন্থালোচক আমাকে প্রতারিত করেছেন।
দলবাজি, গ্রুপবাজি, অশিক্ষা ও অপুষ্টির শিকার আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ঘাড়ে চেপে বসেছে এক ধরনের প্যারাসাইট। এই পরান্নভোগীরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চায় চোখ। স্রেফ ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এদের বিচারবুদ্ধি হয় বিলুপ্ত। বড় হয়ে ওঠে উচ্চাভিলাষ। এজন্য কারণে-অকারণে নিজেদের এই নোংরা টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত লেখক যত জগামগাই হোক, কল্কি পেয়ে যান। যদুর চরকায় তেল দেয় জব্বার, জব্বারের চরকায় তেল দেয় মধু। মধু আবার যদুকে বড় করে তোলে। এই চক্রে এখন পচা পাগাড়ে আবদ্ধ শুয়োরের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য।
এই চক্র নিজেদের লেখক ও লেখকের বইকে নিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। আর তাদের হিসাবের বাইরের লেখক ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে থাকে নিঃশব্দ। এখন আবার এই প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে চটকদার বিজ্ঞাপন। নতুন আরেকটি ফ্যাশন এখন আমাদের সাহিত্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টাটাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বইয়ের মার্কিং করে এ বছরের সেরা ১০ বই, বছরের সেরা ৭ বই ইত্যাদি নামে। এসব ভাগ্যবান বই বা লেখক তাই বলে বাইরের কেউ নয়, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার খোঁয়াড়েই লালিত-পালিত বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন বাচাল লেখক।
কখনও কখনও বড় কিংবা আলোচিত হওয়ার জন্য লেখকদের মধ্যেও কাজ করে নানা ধান্ধাবাজি। এই ধান্ধাবাজির একদিকে থাকে চালাকি, শ্রমবিমুখতা ও তাস্কর্যবৃত্তি। অন্যদিকে থাকে ক্ষমতাসীনদের পা চেটে, তাদের স্তাবক বা নিশানবরদার সেজে ইহলৌকিক তরক্কি অর্জন।
এই জাতীয় লেখক দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছেন আমাদের দুই জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান। একই বই শত শত নামে বেরিয়েছে এ দুজনের জন্য।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক তোলপাড় করা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’র স্রষ্টা ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ‘কত ছবি কত গান’। সেই ইলিয়াস ভাই ’৭১-এর পরে মুজিব বন্দনার সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন ‘মুজিববাদ’ বই দিয়ে। ইলিয়াসের পাঠকরা এতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। আর বিরক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারা। কারণ তাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের বাড়া ভাত যেন কেউ কেড়ে দিতে চাচ্ছে। মুজিববাদের জন্যই ডুবলেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
ড. মাযহারুল ইসলামের বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পড়ে স্বয়ং শেখ মুজিব নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বইটির তথ্যগত ভ্রান্তি এবং বল্গাহারা বিশেষণ প্রয়োগের তাণ্ডব ধরিয়ে দিলে চুপসে যান গ্রন্থকার।
জিয়াউর রহমানকে নিয়েও একই কাণ্ড চলছে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের দ্বারা। এখানে আছে নানা সাইজ ও আয়তনের মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। বিভিন্ন লেখকের লেখা কালেকশন করে এক একজন এক একটা বই বের করেছেন। নিজের নাম ফাটানোর জন্য আছে নানা কায়দা। আবার এই একটি সংগ্রহ থেকেই লেখা নিয়ে আরও চল্লিশজন চল্লিশ নামে বের করেছেন বই। এর কোনো কোনোটির ওজন পাঁচ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নির্যাস নেই পাঁচ ফোঁটাও।
দুই.
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিরচিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনয়িন : গৌরবের দিনলিপি’। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন অ্যাডর্নেরই স্বত্বাধিকারী বন্ধুবর সৈয়দ জাকির হোসাইন। কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য এ ধরনের বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণ গড়পড়তা সাইজ নয়, রয়াল সাইজের এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৭৪। ওজন আনুমানিক ৩ কেজিরও বেশি। বৃদ্ধ এবং শিশুদের পক্ষে এ ধরনের বিশাল গ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, নাড়াচাড়া করাও দুঃসাধ্য।
যে কেউ এরকম জলহস্তির মতো বিরাট কলেবরের বই দেখে সত্যি সত্যি ভিরমি খেতে পারেন।
কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই যেহেতু ঘর পোড়া গরু, সেহেতু ভয় না পেয়ে উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করলাম। যাকে বলে আগাগোড়া স্কানিং করা, সে রকম পাঠ সমাপ্ত করতে মাসখানিক লাগার কথা। আমি বইটি ঘাঁটার (পড়ার জন্য নয়) জন্য সময় নিয়েছি মাত্র দুদিন। সে জন্য এ লেখাকে পাঠ-পরবর্তী নিবেদিত কোনো প্রবন্ধ হিসেবে না দেখে একটা দ্রুতরেখ মানচিত্র বলে ধরে নিলেই বাধিত হবো।
তিন.
ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘ইতিহাস এমনি একটি বিষয়, যা কখনও ঘটেনি এবং এমন লোকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, যে কখনও সেখানে ছিল না।’ প্রথমেই বলে নিই, এ বই সে রকম কোনো ইতিহাসবিদের রচনা নয়। এ বইয়ের লেখক মাহফুজউল্লাহ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক। কখনও তিনি নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা, কখনওবা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে আসা সচেতন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী, কখনওবা নেতা। সঙ্গত কারণেই ছাত্র ইউনিয়নের বিচারে তিনি ইতিহাস-মানুষ। ফলে অন্য দশটি তথাকথিত ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থকার ও গ্রন্থের ফারাক সুস্পষ্ট, দূরত্বও অনেকখানি। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য মানুষের মতো ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান’-এর মতো রুচিহীন কাজ এ গ্রন্থে কোথাও করেননি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনার স্তূপ তিনি খাড়া করেননি। অথচ এর সুযোগ ছিল। এই যে মাত্রাবোধ ও কাণ্ডজ্ঞান, সে জন্যই মাহফুজ উল্লাহ তার এই গ্রন্থের জন্য নন্দিত হবেন। পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখার জন্য এ বই যেমন পাবে পাঠকপ্রিয়তা, তেমনি অর্জন করবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা। এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ জোগাবে উপকরণ ও অনুপ্রেরণা। সে বিচারে এ বই জাতীয় ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি মাহফুজ উল্লাহর এই সময়োপযোগী প্রকাশনাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঠিক গ্রন্থ নয়, এ হলো একটা আর্কাইভস। একটি বিশাল আর্কাইভসের অক্ষরবন্দি রূপ। এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনুধাবনের নানা জিনিসপত্র। কেবল যেন পাঠের জন্য নয়, এ বই রচিত হয়েছে বিচরণের জন্য। উদ্যানের মধ্যে যেমন আমরা হেঁটে বেড়াই, এগাছ-ওগাছের কাছে যাই, এফুল-ওফুলের গন্ধ নেই, বর্ণ দেখে চমত্কৃত হই, কখনও হই বিচলিত—এ হলো সে রকম একটি আয়োজন।
আবার আমাদের ইতিহাসের অনেক হারিয়ে যাওয়া ভূভাগ, বিলুপ্ত অনেক অলিগলি, অনেক মানুষের অপরিসীম ত্যাগের কাহিনী পাঠক এর মধ্যে পাবেন। পাবেন একটি জাতির উত্থান এবং কিছু মানুষের পতনের বেদনাহত সূত্র। এজন্য এ বই আমাদের নিজেদের দেখার আয়নাও বটে। হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। এই পাঠে আমরা বিস্মিত হই, শিহরিত হই, ব্যথিত হই। কিন্তু আয়না থাকে নির্বিকার। এই নির্বিকারত্বই এ গ্রন্থকে মানোত্তীর্ণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি গ্রন্থ বিচারে বসি আমরা, তাহলে যে কেউ স্বীকার করবেন এই গ্রন্থ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশেরও ইতিহাস। এ গ্রন্থ শুধু ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি নয়, জাতীয় গৌরবেরও দিনলিপি।
চার.
বইয়ের শুরুতেই সবিনয় নিবেদনে লেখক বলেছেন, ‘আট বছরের পরিশ্রমের ফসল যে বইটি এখন হাতে নিয়েছেন তা প্রথাসিদ্ধ কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাস রচনার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের ভাণ্ডার।’ আসলেই এ গ্রন্থ একটা উপাত্তের ভাণ্ডার। ১২৭৪ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এ বই ধারণ করেছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৯ বছর।
ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই চারটি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সংগঠনটির জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাবান মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হন। এ ছাত্ররাই কর্মজীবনে দিয়েছেন প্রভূত সাফল্যের পরিচয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যে সময়সীমার কথা নিয়ে এ গ্রন্থ, সে সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ছাত্র ইউনিয়নই ছিল সবচেয়ে প্রাগ্রসর সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সদস্যদের দিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। করেছিল গভীরভাবে আত্মপ্রত্যয়ী। দিয়েছিল গৌরবময় জীবনের সন্ধান। যে গৌরবের সৌরভ আমাদের মতো অভাজনের গায়ে এখনও লেগে আছে।
মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ১৯টি পরিশিষ্টে সৃষ্টি হয়েছে এই বই। প্রতিটি অধ্যায় চিহ্নিত হয়েছে এক-একটি বছরের নামে। এই অধ্যায়গুলোর শুরুতেই আছে মূল বিষয়ের ওপর লেখকের কিঞ্চিত্ আলোকপাত। এরপর আছে ঘটনা প্রবাহ, যা গড়ে উঠেছে কেবল সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কাটিং নিয়ে। তারপর সংযুক্ত হয়েছে তথ্য নির্দেশ, যা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১৮টি অধ্যায়।
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর আলোকপাত, যা লেখকের নিজের লেখা, খুবই সংক্ষিপ্ত, একই সঙ্গে সংযমী ও পরিমিত। বাচালতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি মাহফুজ উল্লাহ।
পরিশিষ্টের ১৯টি অধ্যায় আসলে ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্টস, যা ইতিহাস গবেষকদের জন্য খুলে দেবে এক শস্যভারানত দিগন্ত।
আরও দিকের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আত্মবিশ্বাসহীন লেখককুলের অনেকেই বইয়ের ‘দাম’ বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট কেউকেটাদের দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে তার বাণিজ্যিক ব্যবহার। মাহফুজ উল্লাহ এই কদর্য কাজটি করেননি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই, এই ফাঁকে একটা ধন্যবাদ কি আপনাকে দেব?
আর একটা প্রশ্ন, বর্তমানকার অন্তঃসারশূন্য, দলবাজ ছাত্র সংগঠনগুলো এই বই থেকে কি কিছু শিক্ষা নেবে?
পাঁচ.
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন মাঝেমধ্যেই ভারি ভারি কিতাব প্রকাশ করে। সেগুলো কতটুকু খাদ্য আর অখাদ্য তা বলতে পারবো না। কিন্তু সেসব দেখে চোখ জুড়িয়েছে। বিশেষ করে আনোয়ার দিল অ্যান্ড আফিয়া দিল প্রণীত ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ সম্পাদিত ‘মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ : বাংলাভাষা স্মারক’-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ড. মাহবুব উল্লাহর গ্রন্থটি যখন বের হয় তার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে আমি অষ্টপ্রহর জড়িত। কিন্তু ভুলেও তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তিনি আমার মতো অনেক আমজনতার কাছে পুরো বিষয়টি চেপে রাখেন।
হয়তো তিনি আমাদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রকাশের পর ১০ কেজি ওজনের ঢাউস বইটি তিনি যখন আমার হাতে দেন, আমি আঁেক উঠি এবং হতবাক হই। আরও হতবাক হই, দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তার মোটামুটি জীবনপঞ্জি আছে বইটিতে। কিন্তু তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী—তার উল্লেখ নেই। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের হাতে এমনটা হয়েছে হয়তো তথ্য সংকটের কারণে। তো এই হতবাক দশা এখনও কাটেনি বলে মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের শত গালাগাল শুনেও বইটি নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা হয়ে ওঠেনি।
শেষ করার আগে মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ। কারণ তিনি জানেন ‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ সেজন্যই সেই নারী, তার গৃহের জিম্মাদার দিনারজাদী বেগমকে তিনি ভোলেননি। তার সবিনয় নিবেদন শেষ হয় তার নাতি-নাতনীদের জন্য আশাবাদে—‘আমার তিন নবীন প্রজন্ম আরমান রাকিন হক, দিয়ান জাকারিয়া ও জাহরান হাবীব যদি বড় হয়ে আমার যৌবনে লালিত বিশ্বাসকে ধারণ করে, তাহলে এই বই লেখা সার্থক হবে।’
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ যদি এই বই পাঠ করে উপকৃত হয়, উজ্জীবিত হয়, বাংলাদেশের দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে আসে—তাহলেই হলো।
a_hyesikder@yahoo.com